ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার শরয়ী হুকুম
বর্তমানে শিল্প বিপ্লবের এ যুগে ব্যাংক একাউন্ট খোলা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একটি বিষয়। ব্যবসা- বানিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাউন্ট খোলা জরুরী হয়ে পড়ে। এছাড়াও ব্যাংক একাউন্ট খোলার দ্বারা সম্পদ হেফাযত, ঝুকি এড়ানো, সহজে বিল ও পেমেন্ট(payment) আদান-প্রদান ইত্যাদি সহ আরো বিভিন্ন ধরনের সুযোগ গ্রহন মানুষের উদ্দেশ্য থাকে। আর বর্তমান অনলাইন (online)সার্ভিস তো সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বিশেষভাবে এ,টি,এম বুথ (ATM booth)সার্ভিস মানুষের জীবনকে অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। যার কারনে দিন দিন ব্যাংকের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা প্রচুর পরিমানে বেড়ে যাচ্ছে। আর এর প্রয়োজনও যথেষ্ট পরিমানে অনুভুত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, ব্যাংক একাউন্ট খোলা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কেমন?
এর জবাব জানতে হলে প্রথমত, ব্যাংক একাউন্টসমূহের প্রকারভেদ সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। এরপর উক্ত একাউন্টসমূহের লেন-দেনের ধরন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। তবেই এর হুকুম সংক্রান্ত আলোচনা ফলপ্রসূ হবে।
ব্যাংক সাধারণত তিন ধরনের একাউন্ট খোলা যায়।
১. কারেন্ট একাউন্ট( current Account)চলতি হিসাব।
২. সেভিংস একাউন্ট (savings Account) সঞ্চয়ী হিসাব।
৩. ফিক্সড ডিপোজিট (fixed Deposite )।
১. কারেন্ট একাউন্ট (current Account):
এই একাউন্টের ধরন হল একাউন্ট হোল্ডার ( হিসাবধারী) যে কোন সময় যে কোন পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারে। আর ব্যাংকও উক্ত পরিমাণ টাকা গ্রাহককে দিতে বাধ্য।এর জন্য একাউন্ট হোল্ডারকে আগাম কোন নোটিশ ব্যাংকে পাঠাতে হয় না। বরং একাউন্ট হোল্ডার তার ইচ্ছামত প্রয়োজন অনুপাতে টাকা যে কোন সময় উত্তোলন করতে পারে। কারেন্ট একাউন্টে ব্যাংক কর্তৃক কোন সুদ বা লাভ দেওয়া হয় না। বরং ব্যাংক কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডার থেকে তার অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট হারে বা বাৎসরিক সার্ভিস চার্জ (service change) নিয়ে থাকে।
এই একাউন্টের টাকাগুলো আলাদা রাখা হয় না। বরং অন্যান্য একাউন্টের টাকার সাথে মিশিয়ে রাখা হয়। আর ব্যাংকের এ স্বাধীনতা থাকে যে, সে উক্ত টাকাকে তার প্রয়োজন মাফিক খরচ করতে পারে। তবে একাউন্ট হোল্ডার চাওয়া মাত্র তাকে ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতি হল, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ ব্যাংক আলাদা করে রেখে দেয়। যাতে কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদের সার্বক্ষণিক চাহিদা মেটাতে পারে ।
২. সেভিংস একাউন্ট ( Savings Account) :
এই একাউন্টে টাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি রয়েছে, গ্রাহক যে কোন সময়ে যে কোন পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারে না। বরং তার জন্য কিছু পাবন্দী রয়েছে। যেমন¬¬¬- একদিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমানের বেশি টাকা উত্তোলন করা যায় না, মোটা অংকের টাকা উত্তোলন করতে হলে ব্যাংককে আগাম নোটিশ প্রদান করতে হয়, একেবারে সব টাকা উত্তোলন করা যায় না ইত্যাদি। তবে এই একাউন্টে টাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট কোন মেয়াদ নেই। অর্থাৎ এতদিনের পূর্বে টাকা উত্তোলন করা যাবে না এমন কোন শর্তারোপ করা হয় হয় না। বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যে কোন সময় উত্তোলন করা যায়। বর্তমানে তো বেসরকারী ব্যাংকের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শিথিলতা অবলোকিত হয়। বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে যেমনিভাবে পুরো টাকা একসাথে উত্তোলন করা যায় তেমনিভাবে আগাম নোটিশ ব্যতীত মোটা অংক উত্তোলন করা যায়।
এই একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক তাদের সঞ্চিত অর্থের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা বা সুদ দিয়ে থাকে।
৩. ফিক্সড ডিপোজিট (Fixed deposite):
এই ধরনের একাউন্টে টাকা জমা রাখার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। অর্থাৎ ঐ সময়ের পূর্বে গ্রাহক টাকা উত্তোলন করতে পারবে না। এই একাউন্টেও ব্যাংক জমাকৃত অর্থের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা বা সূদ দেয়। তবে এই সূদ সেভিংস একাউন্টের সূদের চেয়ে সাধারণত বেশি হয়ে থাকে। মূলত ফিক্সড ডিপোজিট সেভিংস একাউন্টের-ই একটি প্রকার। ভিন্ন কোন একাউন্ট নয়।
এছাড়াও সেভিংস একাউন্টের আওতায় আরো বেশ কিছু একাউন্ট রয়েছে। যেমন স্যালারি একাউন্ট, পেনশন একাউন্ট ইত্যাদি। মূলত ঐগুলো সেভিংস একাউন্টের
আওতায় পড়ে।
ব্যাংকে ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থানঃ
ব্যাংক একাউন্টের শরয়ী হুকুম জানতে হলে প্রথমে ব্যাংক ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থান জানা প্রয়োজন। অর্থাৎ আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, গ্রাহক ব্যাংকে যে টাকা গচ্ছিত রেখেছে তা কিসের ভিত্তিতে? আমানতের ভিত্তিতে নাকি ঋনের ভিত্তিতে? নাকি এক্ষেত্রে ভিন্ন সূরত রয়েছে?
ব্যাংক একাউন্টের তিন প্রকারেই গ্রাহক এতটুকু নিশ্চয়তা লাভ করে যে , সে জমাকৃত টাকা সর্বাবস্থায় ফেরত পাবে। যদি উক্ত টাকা ব্যাংক থেকে হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তবে সর্বাবস্থায় একাউন্টের হোল্ডার তার টাকা ফেরত পাবে। আবার ব্যাংকের পক্ষ থেকেও এমন ঘোষণা থাকে যে, গ্রাহক তাদের টাকা সর্বাবস্থায় ফেরত পাবে। যদি ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা না থাকে অথবা গ্রাহক জানতে পারে যে, তার টাকা খোয়া যাওয়ার আশংকা রয়েছে তবে জনসাধারন ব্যাংকে টাকা রাখা বন্ধ করে দিবে।
মোটকথা ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ের ক্ষেত্রে এটা স্বতসিদ্ধ যে, গ্রাহক সর্বাবস্থায় তার গচ্ছিত টাকা ফেরত পাবে। আর এটাকেই ঋন বলে। মানুষ এটার নাম যাই দিক না কেন তা ঋন হিসেবে ধর্তব্য হবে। কেননা লেনদেনের ক্ষেত্রে নামের কোন প্রভাব থাকে না। বরং তার ব্যবহারিক দিক ও অর্থ ধর্তব্য হয়। তাছাড়া ব্যাংকে টাকা রাখার দ্বারা গ্রাহকের উদ্দেশ্য থাকে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে সাথে অতিরিক্ত মুনাফা (সূদ) অর্জন। যাই হোক, গ্রাহক কতৃক ব্যাংকের যে কোন প্রকার একাউন্টে টাকা ডিপোজিট করাতে একাউন্ট হোল্ডার ও ব্যাংকের মাঝে যে চুক্তি সম্পন্ন হয় তা শরিআতের পরিভাষায় ঋন বা কর্য ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা ব্যাংক একাউন্টের প্রকারভেদ এবং উক্ত একাউন্টসমূহে ডিপোজিটকৃত অর্থের শরয়ী অবস্থান আমরা জানতে পেরেছি। নিম্নে উল্লেখিত একাউন্টসমুহ খোলা এবং তাতে টাকা রাখার শরয়ী হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
১। করেন্ট একাউন্ট ( current Account ) খোলা এবং তাতে টাকা রাখার শরয়ী হুকুমঃ
সূদী ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্ট খোলা শর্তসাপেক্ষে জায়েয। যদি একাউন্ট হোল্ডারের সূদী কারবারে সহযোগীতার নিয়ত থাকে তবে তার জন্য কারেন্ট একাউন্ট খোলা হারাম। আর যদি সূদী কারাবারে সহযোগিতার নিয়ত না থাকে বরং শুধুমাত্র টাকা হেফাজত উদ্দেশ্য হয় এবং তার একাউন্ট খোলা অত্যন্ত প্রয়োজন হয় তবে তার জন্য এ একাউন্ট খোলা জায়েয। তবে যদি কারো ব্যাংকে একাউন্ট খোলা প্রয়োজন না হয় আর তার সূদী কারাবারে সহযোগীতার নিয়ত না থাকে তবে তার জন্য কারেন্ট একাউন্ট খোলা মাকরুহে তানযীহী। (রদ্দুল মুহতার ৫/২৭২, নাইলুল আউতার ৫/১৫৪, মুফতী শফী (রহঃ) আহকামুল কুরআন ৩/৭৪, সূরা মায়েদা, আয়াত ২, জাওয়াহিরুল ফিকহ ২/৪৫৩, ফিকহী মাকালাত ৩/৩৯)।
এখানে একটি আপত্তি আসে যে, উক্ত ব্যক্তি তো জানে যে, ব্যাংক তার টাকার সহযোগীতায় সূদী কারাবার করবে। তাহলে জেনে শুনে ব্যাংককে সূদী কারাবারে সহযোগিতা কিভাবে জায়েয হতে পারে?
আল্লামা তাক্কী উছমানী সাহেব দামাত বারাকাতুহুম উক্ত আপত্তির কয়েকটি জবাব খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন-
১. ব্যাংক কারেন্ট একাউন্টে ডিপোজিতকৃত সকল টাকা ব্যবহারে আনে না। বরং তাতে সঞ্চিত অর্থের একটা বড় অংশ আলাদা করে রেখে দেয়। যাতে করে কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদের সার্বক্ষণিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। কাজেই কোন একাউন্ট হোল্ডার একথা সুনিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, তার টাকাই সূদী কারাবারে ব্যবহৃত হচ্ছে। বরং উভয়টির সম্ভাবনা রয়েছে।
২. ব্যাংকের ইনভেস্টের (অর্থায়ন) অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যার সবগুলো হারাম নয়। বরং অনেক জায়েয ক্ষেত্রও রয়েছে। কাজেই কোন হিসাবধারী একথা নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, তার জমাকৃত অর্থ কোন নাজায়েয কারাবারে খাটানো হয়েছে।
৩।সুদবীহিন ঋন বা করজ একটি শরীআতসম্মত লেনদেন। আর মুদ্রার হুকুম হল তা সহীহ আকদসমূহে নির্দিষ্ট করার দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না।
তাছাড়া গ্রাহক যখন ব্যাংককে ঋন দেয় তখন উক্ত টাকা ঐ বাক্তির মালিকানা থেকে বের হয়ে ব্যাংকের মালিকানায় প্রবেশ করে। অতঃপর ব্যাংক ঐ টাকার দ্বারা যে কারবার করে তা উক্ত ব্যক্তির কারবার হিসেবে ধর্তব্য হবে না। বরং ব্যাংকের নিজস্ব কারবার হিসেবে পরিগণিত হবে। কাজেই ব্যাংকের কারবারকে উক্ত ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা ঠিক হবে না।
৪. গোনাহের সাহায্য করা বা কারন হওয়া যদিও হারাম তবে ওলামায়ে কেরাম এর কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন। যদি সর্বপ্রকার কারন নিষিদ্ধ করা হয় তবে মানুষের জিবন সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। যেমন কেউ চাউল কিনতে এলে দোকানদার একথা চিন্তা করল সে এই চাউল খেয়ে চুরি করতে পারে। এমনটি হলে তো তার পক্ষে চাউল বিক্রি বিক্রি করা সম্ভবই হবে না। বরং দুনিয়ার কোন কাজই জায়েয থাকবে না। কাজেই গোনাহের কারনকে নিকটবর্তী ও দূরবর্তীতে বিভক্ত করতে হবে। আর সূদী কারবারের সহযোগী নিয়ত ব্যতীত কারেন্ট একাউন্ট টাকা রাখা সরাসরি সূদী কারবারে সহযোগিতার মত নয়। বিশেষ করে যখন উপরে উল্লেখিত সম্ভাবনাগুলো রয়েছে।
_ ফিকহী মাকালাত ৩/৩২-৩৮
সারকথা, সূদী কারবারের নিয়ত ব্যতীত প্রয়োজনবশত কারেন্ট একাউন্ট খোলা ও তাতে টাকা রাখা জায়েয। প্রয়োজন না হলে মাকরুহে তানযীহী। আর সূদী কারবারের সহযোগিতার নিয়ত থাকলে কারেন্ট একাউন্টেও টাকা রাখা হারাম।
২। ফিক্সড ডিপোজিট এর শরয়ী হুকুমঃ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফিক্সড ডিপোজিটে গ্রাহক কতৃক ডিপোজিটকৃত অর্থ মূলত ঋন বা করজ। কাজেই একাউন্ট হোল্ডার তার সঞ্চয়কৃত অর্থের চেয়ে যা-ই বেশি নিবে তা স্পষ্ট সূদ হবে। যা জায়েয হবার কোন সুরত নেই। কাজেই কোন মুসলমানের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করা এবং তাতে অর্থ রাখা জায়েয নেই।
৩। সেভিংস একাউন্ট খোলা এবং তাতে অর্থ রাখার শরয়ী হুকুমঃ
সেভিংস একাউন্টও যেহেতু ঋনের হুকুমে কাজেই এ একাউন্টেও গচ্ছিত টাকার চেয়ে বেশি গ্রহন করা যাবে না। তা সূদ হওয়ার কারনে সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম।
উপরোক্ত দুই প্রকার (সেভিংস একাউন্ট ও কারেন্ট একাউন্ট) এ টাকা রাখা যেমন হারাম তেমনিভাবে একাউন্ট খোলাও হারাম। কেননা একাউন্ট খোলার অর্থই হল, সে সূদী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। সূদ গ্রহন না করলেও চুক্তিতে সম্মত হওয়া ভিন্ন একটি গুনাহ।
অনেকে মনে করে, ফিক্সড ডিপোজিট বা সেভিংস একাউন্ট করে সে সূদের টাকা নিজে নিবে না বরং ছদকাহ করে দিবে। আর এর দ্বারাই সে দায়মুক্ত হয়ে যাবে এবং গরীবেরও কিছু উপকার হবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। এটা তো পরবর্তীতে তাওবাহ করার নিয়তে গুনাহ করার মত বা একজনের উপর জুলুম করে অন্য কারো উপর এহসান করার মত। অথচ উভয়টি জঘন্যতম গুনাহ। হাদীসে তো যে সূদ খায় তার উপর লানত এসেছে।
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ
সূদ যে খায় এবং দেয় তাদের উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লানত দিয়েছেন।–সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪১৭৬।
উক্ত হাদীসে এটা বলা হয়নি যে ছদকাহ করলে তা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। চোরও তো চুরি করে বিভিন্ন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করে থাকে। এর দ্বারা কি সে চুরির গোনাহ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। বিশেষ করে সূদের মত একটি ভয়াবহ গোনাহ যার ভয়াবহতা আল্লাহ্ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
“( সূদের ভয়াবহতা জানার পরেও যদি তোমরা ছেড়ে না দাও , তবে আল্লাহ্ ও তার রসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তূত হও)” -সূরা বাকারাহ, আয়াত ২৭৯
কত বড় মারাত্মক কথা আল্লাহ্ তাআলা খালেক হয়ে সামান্য মাখলূকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। পুরো কুরআন শরীফে মাত্র এই একটি জায়গায় আল্লাহ্ তাআলা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এখানে মূলত যুদ্ধ ঘোষণা উদ্দেশ্য নয় বরং সূদের ভয়াবহতা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। কাজেই সূদের মত ভয়াবহ গুনাহের ক্ষেত্রে তা গ্রহন করে ছদকাহ করা কখনই সমীচিন হতে পারে না।
হ্যাঁ, ছদকাহ করার হুকুম তাকে দেওয়া হয় যার মালিকানায় কোনভাবে সূদ এসে গেছে। কিন্তু বুঝে শুনে সূদ গ্রহন করে ছদকাহ করা কখনই জায়েয নয়।
অনেকে মনে করে সেভিংস একাউন্টে টাকা দীর্ঘদিন ফেলে রাখলেই কেবল সূদ আসে। একাউন্টে টাকা জমা হবার ২/৪ দিনের মধ্য তুলে ফেললে বা হঠাৎ লেনদেন করলে সূদও জমা হবে না এবং এতে কোন গুনাহ হবে না।
উক্ত ধারনাটিও সঠিক নয়। কেননা যদি এটা ধরে নেওয়া হয় যে, টাকা ডিপোজিটের ২/৪ দিনের মধ্য তুলে নিলে কোন সূদ জমা হয় না। তবে সকল ব্যাংকে সেভিংস একাউন্ট খুলতে হলে একাউন্টে সর্বদা একটা সর্বনিম্ন পরিমাণ ( minimum balance) টাকা জমা রাখতে হয়। যা উত্তলনযোগ্য নয়। ঐ নুন্যতম টাকার উপরে ব্যাংক বাৎসরিক সূদ দিয়ে থাকে। মোটকথা সেভিংস একাউন্ট খলার অর্থই হল সূদি চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। যা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম।
এক্ষেত্রে অনেকে আরেকটি খোঁড়া যুক্তি উত্তাপন করে থাকে। তা হল সাধারন মানুষের জন্য কারেন্ট একাউন্ট খোলা সম্ভব নয়। কেননা ট্রেড লাইসেন্স (Trade lisence)টিন সার্টিফিকেট (TIN certificate) ব্যতীত কারেন্ট একাউন্ট খোলা যায় না।
উক্ত বক্তব্যও সঠিক নয়। কেননা ব্যাংক নীতিমালা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স বা টিন সার্টিফিকেট ব্যতীত ব্যক্তিগত নামে কারেন্ট একাউন্ট হতে পারে। আমি নিজেই তো কোন কাগজ পত্র ব্যতীত ব্যক্তিগত নামে কারেন্ট একাউন্ট করেছি। তবে একথা সত্য যে , ব্যাংক ব্যক্তিগত নামে কারেন্ট একাউন্ট খুলে দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। এখন কেউ যদি সামান্য ঝামেলা এড়াতে বা একেবারে নগণ্য অজুহাতে সূদ খেতে চায় (সেভিংস একাউন্ট খুলতে চাই) তবে কে তাকে সূদ থেকে বাঁচাবে? মুমিন তো সর্বদা সুদ থেকে বাঁচার অজুহাত খুঁজবে সূদ খাওয়ার অজুহাত নয়।
উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হল ব্যাংকে প্রয়োজনের খাতিরে কারেন্ট একাউন্ট খোলা সূদী কারবারে সহযোগিতা করার নিয়ত না থাকলে জায়েয। আর সেভিংস একাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট করা সর্বাবস্থায় নাজায়েয।
এ তো গেল সাধারণ সূদী ব্যাংকগুলোর হুকুম। এখানে প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয় চলে আসে তা হল, আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর হুকুম কি? তাতে একাউন্ট খোলার শরঈ হুকুম কি? এবং উক্ত ইসলামী ব্যাংকগুলো কর্তৃক প্রদেয় মুনাফার হুকুমই বা কি?
আসলে ব্যাংকগুলোকে ইসলামী রুপ (Islamization)দেওয়া অত্যন্ত নেক ও মহৎ একটি উদ্যোগ। আমরা অবশ্যই তাদেরকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাই যদি তারা সঠিক মাসায়েল জেনে তদানুযায়ী ব্যাংক পরিচালনা করেন। এজন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় হল ব্যাংকের সর্বপ্রকার লেনদেন মুহাক্কিক মুফতিয়ানে কেরামের নেগরানিতে হওয়া চাই এবং প্রত্যেক ব্রাঞ্চে কমপক্ষে একজন বিজ্ঞ মুফতী থাকবেন যিনি সর্বপ্রকার লেনদেন তদারকি করবেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিপূর্ণ ইসলাম অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। বড় বড় ইসলামী বাক্তিও মজলিসে শূরার মধ্যে থাকলেও লেনদেন তাদের কোন কার্যকারী ভূমিকা থাকে না। বরং তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শুধুমাত্র ব্যাংকের AGM এ পুতুল সদৃশ তাদেরেকে রাখা হয়। অথচ শুধু এতটুকু দ্বারাই ব্যাংকের ইসলামীকরন হতে পারে না।
ইসলামী ব্যাংকগুলো মূলত কয়েকটি পদ্ধতিতে অর্থায়নে (financing) আসতে পারে।
১। মুশারাকাহ
২। মুযারাবা
৩। মুরাবাহা
৪। ইজারাহ(Lease)
৫। সলম
৬। ইস্তেসনা
উপরোক্ত প্রতিটি লেনদেনের শরঈ রূপরেখা ও বিস্তারিত আহকামাত রয়েছে। যেগুলো সম্পর্কে কেবল বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম অবগত। এগুলো পরিচালনার জন্য ভাসা ভাসা জ্ঞান যথেষ্ট নয়। বিশেষভাবে লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্যের মাসায়েল অন্যান্য মাসায়েল থেকেও একটু জটিল হয়ে থাকে। উপরোক্ত অধিকাংশ লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা খাতা কলমে ইসলামী ব্যাংকিং দেখালেও বাস্তবে তারা সূদী কারবার করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা অপর্যাপ্ত জনবলের অজুহাতে সূদী কারবারে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষকরে বাইয়ে মুরাবাহার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তারা পন্যের বদলে টাকা আদান-প্রদান করে থাকে। যা স্পষ্ট সূদ। এছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা শরীআতের শর্তাবলী রক্ষা করতে পারে না। প্রচলিত সকল ইসলামী ব্যাংকের স্বতসীদ্ধ একটি সূদী কারবার হল বাইয়ে মুরাবাহা মুয়াজ্জলাহ ( দীর্ঘমেয়াদী কিস্তির ভিত্তিতে বিক্রি)। এর ক্ষেত্রে কেউ যদি কোন একটি কিস্তি (Instalment) দিতে অপারগ হয় বা দেরি করে তবে ঐ পরিমাণের বিপরীতে সময়ের অনুপাতে চার্জ বা মুনাফার নামে একটি পরিমাণ ধার্য করে দেয়। অথচ পণ্যের চুক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের উপর পূর্বেই হয়ে গিয়েছে। এখন সময়ের বিপরীতে যে পরিমাণ ধার্য করা হল তা নিঃসন্দেহে সূদ।আমার জানা মতে কোন ইসলামী ব্যাংকই এক্ষেত্রে ছাড় দেয় না। আমি নিজে একবার হাউস ফাইনেন্স এর ব্যাপারে আমাদের দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকের ২টি ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছিলাম। দুজনের কেউই আমাকে সরীআতসম্মত পদ্ধতিতে লেনদেনটির সমাধান দিলেন না। একজনতো বলে বসলেন হুজুর আপনারা প্রদেয় টাকার বেশি নেওয়াকেই সূদ মনে করেন যা ঠিক নয়। এরপর তিনি তার বক্তব্য চালিয়ে গেলেন। আমি উঠে চলে এলাম।
যাই হোক, এখানে তাদের প্রতিটি লেনদেনের সরুপ উদ্ঘাটন উদ্দেশ্য নয়। এর জন্য ভবিষ্যতে কখনও সুযোগ হলে লিখব ইনশাআল্লাহ্। বরং তাদের লেনদেনের বাস্তবতা বুঝানো উদ্দেশ্য।
সারকথা, বর্তমানে আমাদের দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো সূদমুক্ত নয়। যার কারনে তাতে ফিক্সড ডিপোজিট বা সেভিংস একাউন্ট খোলা অন্যান্য ব্যাংকের মত নাজায়েয, যতক্ষণ না তারা তাদের সার্বিক কার্যক্রম ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনা না করে। উক্ত একাউন্টদ্বয় থেকে কারো নিকট মুনাফার নামে কোন কিছু এসে থাকলে তাও ছাওয়াবের নিয়ত ব্যতীত ছদকাহ করা ওয়াজিব। তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে কারেন্ট একাউন্ট খোলা জায়েয। আমার জানা মতে আমাদের দেশের গ্রহণযোগ্য দারুল ইফতাগুলোর তাহক্কীক ও ফাতওয়া এমনই।