প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম, ১। কুরআন শরীফ শিখিয়ে বেতন অথবা হাদিয়া নেয়া যাবে কি? ২। কুরআন শরীফ শিখিয়ে ধনুক নেয়া এবং ছাগল হাদিয়া নেয়া হাদীস দুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই?
উত্তর :ওয়া আলাইকুমুস সালাম
১+২। এ বিষয়ে বিপরীতধর্মী হাদীস পাওয়া যায়। হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) এর হাদীস থেকে বুঝে আসে কুরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নেওয়া হারাম।
عن أبي بن كعب قال علمت رجلا القرآن فأهدى إلي قوسا فذكرت ذلك لرسول الله صلى الله عليه و سلم فقال إن أخذتها أخذت قوسا من نار فرددتها
অর্থঃ হযরত উবাই বিন কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে কুরআন শিক্ষা দিলাম। ফলে সে আমাকে একটা ধনুক হাদিয়া দিল। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা জানালে তিনি বললেন, যদি তুমি তা গ্রহন কর তবে জাহান্নামের একটা ধনুক গ্রহন করলে।–সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ২১৫৭
অন্য বর্ণনায় রয়েছে-
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ عَلَّمْتُ نَاسًا مِنْ أَهْلِ الصُّفَّةِ الْكِتَابَ وَالْقُرْآنَ فَأَهْدَى إِلَىَّ رَجُلٌ مِنْهُمْ قَوْسًا فَقُلْتُ لَيْسَتْ بِمَالٍ وَأَرْمِى عَنْهَا فِى سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ لآتِيَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَلأَسْأَلَنَّهُ فَأَتَيْتُهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ رَجُلٌ أَهْدَى إِلَىَّ قَوْسًا مِمَّنْ كُنْتُ أُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْقُرْآنَ وَلَيْسَتْ بِمَالٍ وَأَرْمِى عَنْهَا فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ « إِنْ كُنْتَ تُحِبُّ أَنْ تُطَوَّقَ طَوْقًا مِنْ نَارٍ فَاقبَلْهَا »
অর্থঃ হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আহলে সুফফার কয়েকজনকে কিতাব ও কুরআন শিক্ষা দিলাম। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি আমাকে একটি ধনুক হাদিয়া দিল। আমি ভাবলাম, (এটা তো) তেমন কোন সম্পদ না। তাছাড়া তা আমি আল্লাহর রাস্তায় নিক্ষেপ করব। আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট যাব এবং তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করব। অতঃপর আমি তার নিকট এলাম এবং বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি যাদেরকে কিতাব ও কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলাম তাদের একজন আমাকে একটি ধনুক হাদিয়া দিয়েছে। আর সেটা তো তেমন কোন সম্পদ নয়। যা আমি আল্লাহর রাস্তায় নিক্ষেপ করব। তখন তিনি বললেন, যদি তুমি পছন্দ কর যে, আগুনের তৈরি একটা হার তোমার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে তবে টা গ্রহন কর।–সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩৪১৮
উক্ত হাদীস দুটিতে বিনিময় নেওয়া প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভিতি প্রদর্শন নাজায়েয হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। আর এটাই হানাফীদের মুল মাযহাব। তবে ইমাম শাফী (রহঃ) এর নিকট কুরআন ও অন্যান্য বেশ কিছু জিনিসের বিনিময় নেওয়া সম্পূর্ণ জায়েয। তার দলীল নিম্নোক্ত হাদীস-
عن أبي سعيد الخدري رضي الله عنه أن ناسا من أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم أتوا على حي من أحياء العرب فلم يقروهم فبينما هم كذلك إذ لدغ سيد أولئك فقالوا هل معكم من دواء أو راق فقالوا إنكم لم تقرونا ولا نفعل حتى تجعلوا لنا جعلا فجعلوا لهم قطيعا من الشاء فجعل يقرأ بأم القرآن ويجمع بزاقه ويتفل فبرأ فأتوا بالشاء فقالوا لا نأخذه حتى نسأل النبي صلى الله عليه و سلم فسألوه فضحك وقال وما أدراك أنها رقية خذوها واضربوا لي بسهم
অর্থঃ হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে কতিপয় সাহাবী আরবের এক গোত্রের নিকট আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন মেহমানদারী করল না। তারা সেখানে থাকা কালেই হঠাৎ সেই গোত্রের নেতাকে সাপ দংশন করল। তখন তারা আসে বলল, আপনাদের কাছে কি কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁকারী কোন লোক আছেন কি? তারা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তবে তোমরা আমাদের কোন মেহমানদারী করনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন বিনিময় নির্ধারণ না করা পর্যন্ত আমরা তা করবো না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল বকরী বিনিময় স্বরূপ দিতে রাজী হল। তখন একজন সাহাবী উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং মুখে থুথু জমা করে তা সে ব্যক্তির নিকট ছিটিয়ে দিলেন। ফলে সে আরোগ্য লাভ করল। এরপর তারা বকরীগুলো নিয়ে এসে বললো, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করার পূর্বে তা স্পর্শ করবো না। এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুনে হেসে দিলেন এবং বললেন, তোমরা কিভাবে জানলে যে, এটি রোগ নিরাময়কারী? ঠিক আছে বকরীগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও একটা অংশ রেখে দিও।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৪১৭; জামে তিরমিজী, হাদীস নং ২০৬৩
উক্ত হাদীস থেকে কুরআনের বিনিময় গ্রহন করা জায়েয বুঝে আসে।
হানাফীদের পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম যদিও কুরআন শিক্ষার বিনিময় গ্রহন করাকে নাজায়েয বলেছেন কিন্তু পরবর্তী উলামায়ে কেরাম জরূরতের ভিত্তিতে জায়েয হওয়ার ফাতওয়া দিয়েছেন। জরূরতের ব্যাখ্যা হল, পূর্ববর্তী যুগে মুআযযিন, ইমাম, মুআল্লিম, মুফতীসহ অন্যান্যদের ভাতা বাইতুল মাল থেকে নির্ধারিত ছিল। এজন্য তাদের বিনিময় না নিয়ে খেদমত করাতে কোন সমস্যা হত না। আর এধরনের ইবাদাতের বিনিময়হীন ব্যবস্থাপনা করাও সম্ভব ছিল। কিন্তু যখন এ ধারা শেষ হয়ে গেল এবং ভাতা বন্ধ হয়ে গেল তখন আযান, ইমামতি, তালীম, ফাতওয়া দেওয়া, বিচারকার্য সমাধান করা সহ দ্বীনী বিভিন্ন বিষয়ে অব্যবস্থাপনা প্রকট হয়ে উঠল। বরং দ্বীনের বিভিন্ন নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রবল আশংকা দেখা দিল। তখন পরবর্তী উলামায়ে কেরাম উক্ত হাদীসের (বকরীর পাল নেওয়া) ভিত্তিতে এগুলোর বিনিময় নেওয়া জায়েয বলেছেন। তা না হলে দ্বীন হেফাযত করা মুশকিল।–রদ্দুল মুহতার ৬/৫৫; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৭/১১৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৪/৪৪৮; তানকীহুল ফাতাওয়া আলহামিদিয়্যাহ ২/১৩৭; হিদায়া ৩/৩০১