যঈফ হাদীসের উপর যখন আমল করা ওয়াজিব
কোন যঈফ হাদীসকে উম্মত যখন কবূলের দৃষ্টিকোন থেকে গ্রহণ করে তখন তার উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
কখনও কখনও কোন হাদীসের প্রতি সহীহ হওয়ার হুকুম লাগানো হয় যখন তা উম্মত (এর আয়িম্মায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীন) কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে। যদিও তার কোন সহীহ সনদ না থেকে থাকে। হাফেয সাখাবী (রহঃ) ফাতহুল মুগীছে বলেন –
إذا تلقت الأمة الضعيف بالقبول يعمل به على الصحيح حتى أنه ينزل منزلة المتواتر في أنه ينسخ المقطوع به ولهذا قال الشافعي رحمه الله في حديث لا وصية لوارث إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول وعملوا به حتى جعلوه ناسخا لآية الوصية له
অর্থঃ উম্মত যখন কোন যঈফ হাদীসকে কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তখন তার উপর আমল করা হবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী। এমনকি তা মুতাওয়াতের এর পর্যায়ে পৌছে যায়। ফলে তা অটাক্যভাবে প্রমাণীত কোন বিষয়কেও রহিত করে দেয়। এজন্যই ইমাম শাফী (রহঃ) “ওয়ারিসের জন্য কোন ওসিয়ত নেই” এই হাদীসের ব্যপারে বলেছেন মুহাদ্দিসীনে কেরাম উক্ত হাদীসটি সহীহ সনদে মেনে নেননি। তবে উম্মত তা গ্রহণ করেছে এবং তার উপর আমল করেছে। এমনকি কুরআনের ওসিয়তের আয়াতকে পর্যন্ত তা রহিত করে দিয়েছে।- হাফেয সাখাবী, ফাতহুল মুগীছ, পৃষ্ঠা ১২০
আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) বলেন-
قال ابن عبد البر في الاستذكار : لما حكى عن الترمذي أن البخاري صحح حديث البحر : « هو الطهور ماؤه » ، وأهل الحديث لا يصححون مثل إسناده . لكن الحديث عندي صحيح ؛ لأن العلماء تلقوه بالقبول
অর্থঃ ইবনু আব্দিল বার তার ইস্তেযকার নামক কিতাবে যখন তিরমিজী (রহঃ) এর এই বক্তব্য বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী সুমুদ্রের হাদীসকে সহীহ বলেছেন “তার পানি পবিত্র” অথচ মুহাদ্দিসীনগণ এ ধরনের সনদকে সহীহ বলেন না ’ তখন বলেন তবে হাদীসটি আমার নিকট সহীহ কেননা উলামায়ে কেরাম তা কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন।- আল্লামা সুয়ূতী, তাদরীবুল রাবী, পৃষ্ঠা ২৫
আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) বলেন “হাদীসটি তিরমিজী (রহঃ) এনেছেন এবং বলেছেন ইমাম আহমাদ সহ অন্যরা হুসাইনকে যঈফ বলেছেন। আহলে ইলমদের নিকট উক্ত হাদীসের উপর আমল জারী রয়েছে। একথা দ্বারা তিরমিজী (রহঃ) এদিকে ইশারা করেছেন যে, হাদীসটি উলামাদের সমর্থনে শক্তিশালী হয়েছে। আর অনেকেই স্পষ্টভাবে একথা উল্লেখ করেছেন আহলে ইলমদের কোন হাদীসের সপক্ষে বক্তব্যই হাদীস সহীহ হওয়ার দলীল। যদিও তার নির্ভরযোগ্য কোন সনদ না থেকে থাকে। আত-তাআক্কুবাত, পৃষ্টা ১২
অন্যত্র আল্লামা সুয়ুতী (রহঃ) বলেন-
يحكم للحديث بالصحة إذا تلقاه الناس بالقبول وإن لم يكن له إسناد صحيح
অর্থঃ যখন মানুষ কোন হাদীসকে কবূলের দৃষ্টি কোন থেকে গ্রহণ করে তখন উক্ত হাদীসকে সহীহ হওয়ার ফয়সালা দেওয়া হয়। যদিও তার কোন সহীহ সনদ না থেকে থাকে। -তাদরীবুর বারী, পৃষ্ঠা ২৪
হাফেয ইবনে হাজার বলেন-
কোন হাদীস কবূল হওয়ার গুনাবলীর মধ্য হতে একটি হল হাদীসের বিষয়বস্তুর উপর উলামায়ে কেরাম আমলের ব্যপারে একমত হবেন। এমন হাদীসকে কবূল করা হবে এমনকি তার উপর আমল করা ওয়াজিব। আয়িম্মায়ে উছুলের একটি জামাআত এমনটি বলেছেন।
তার উদাহরণ সমূহের মধ্য থেকে হল, ইমাম শাফী (রহঃ) এর বক্তব্য নাপাকী পানিতে প্রবেশের দ্বারা নাপাক হওয়ার ব্যপারে যখন পানির স্বাদ বা গন্ধ বা রং পরিবর্তন হয়ে যায়, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন সূত্রে বর্ণিত যা মুহাদ্দিসীনগণ (আমলযোগ্য) সাব্যস্ত করেন না। অথচ এটাই সকলের মত। উলামাদের এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ আমার জানা নেই। – আল ইফসা আলা নুকাতি ইবনুস সালাহ
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম হাম্বলী (রহঃ) কিতাবুর রূহ এ মৃত ব্যক্তিকে কবরে তালকীনের ব্যপারে মু’জামে তাবারানীর একটি হাদীস উল্লেখ করে বলেন, হাদীসটি যদিও (সহীহ সূত্রে) প্রমাণীত নয় তবে সকল যুগে ও সকল শহরে হাদীসটির উপরে কোন আপত্তি ছাড়াই আমল চালু থাকা হাদীসটির উপর আমলের জন্য যথেষ্ট।
এর পূর্বে তিনি বলেন ইমাম আহমাদকে (রহঃ) এ আমলের ব্যপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি এটাকে উত্তম বলেছেন এবং উক্ত হাদীসের উপর উম্মতের আমলকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। কিতাবর রূহ, পৃষ্ঠা ১৪
মুহক্কিক ইবনুল হুমাম (রহঃ) ফাতহুল ক্বদীরে বলেন-
وَمِمَّا يُصَحِّحُ الْحَدِيثَ أَيْضًا عَمَلُ الْعُلَمَاءِ عَلَى وَفْقِهِ وَقَالَ مَالِكٌ شُهْرَةُ الْحَدِيثِ بِالْمَدِينَةِ تُغْنِي عَنْ صِحَّةِ سَنَدِهِ
অর্থঃ কোন হাদীসের স্বপক্ষে উলামায়ে কেরামের আমল হাদীসটিকে সহীহ সাব্যস্ত করার একটি কারণ। আর ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন কোন হাদীস মদীনাতে প্রসিদ্ধ হওয়া তার সনদ সহীহ হওয়াকে বেনিয়াজ করে দেয়। – ফাতহুল ক্বাদীর ৩/১৪৩
নিম্নে এমন কিছু হাদীস দেওয়া হল যেগুলো সনদের দিক দিয়ে দূর্বল তবে উম্মত তা কবুলের দৃষ্টিকোন থেকে গ্রহণ করেছে এবং তার উপর আমল চালু রেখেছে –
ক) من ذرعه قىء وهو صائم فليس عليه قضاء وإن استقاء فليقض
যার রোযা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত বমি হয়ে যায় তার (রোযা) ক্বাযা করতে হবে না। আর যদি ইচ্ছাকৃত বমি করে তবে সে যেন ক্বাযা করে নেয়।–সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ২৩৮২
হাফেয ইবনে হাজার ফাতহুল বারীতে বলেন বুখারী (রহঃ) তারিখে কাবীরে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি সহীহ নয়।
হাদীসটি চার সুনানের ইমাম এবং হাকেম নাইসাবূরী ঈসা বিন ইউনুসের সনদে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজী বলেছেন হাদীসটি গরীব। ঈসা বিন ইউনুস ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে হাদীসটি আমার জানা নেই। আমি বুখারীকে তার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন আমি তাকে মাহফূজ মনে করি না।
হাদীসটিকে ইবনে মাজাহ এবং হাকেম হাফস বিন গিয়াসের সূত্রে বর্ণনা করেছেন। অবশেষে তিরমিজী বলেন হাদীসটি আবূ হুরাইরা থেকে একাধিক সূত্রে বর্ণিত আছে। তার সনদ সহীহ নয়। তবে উলামাদের আমল তার উপরই জারী রয়েছে।–সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ৭২০
খ) عن يعلى بن مرة عن أبيه عن جده كانوا مع النبي صلى الله عليه و سلم في مسير فانتهوا إلى مضيق وحضرت الصلاة فمطروا السماء من فوقهم والبلة من أسفل منهم فأذن رسول الله صلى الله عليه و سلم وهو على راحلته وأقام فتقدم على راحلته فصلى
بهم يومئ إيماء يجعل السجود أخفض من الركوع قال أبو عيسى هذا حديث غريب تفرد به عمر بن الرماح [ البلخي ] لا يعرف إلا من حديثه
وقد روى عنه غير واحد من أهل العلم
وكذلك روي عن أنس بن مالك أنه صلى في ماء وطين على دابته
والعمل على هذا عند أهل العلم
অর্থঃ ইয়ালা ইবনে মুররাহ তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন আমরা কোন এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম। অতঃপর নামাযের সময় হলে বৃষ্টি বর্ষিত হল। আকাশ থেকে পানি এবং নিচ থেকে কাদা। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায প্রস্তুত করলেন এবং ছাওয়ারীতে একটু এগিয়ে গেলেন। অতঃপর তাদেরকে নিয়ে ইশারায় নামায আদায় করলেন। আর সিজদায় রুকূ থেকে একটু বেশী ঝুকলেন।- সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ৪১১
হাদীসটিকে বাইহাক্বী, ইবনুল আরবী ও ইবনে কাত্তান যঈফ বলেছেন। ইমাম তিরমিজী বলেন তবে হাদীসটির উপর উলামায়ে উম্মতের আমল চালু রয়েছে। আর ইমাম আহমাদ ও ইসহাকও এমনটি বলেছেন।
গ) عن سراقة بن مالك قال حضرت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقيد الأب من ابنه ولا يقيد الابن من أبيه
অর্থঃ হযরত সুরাকা বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি পিতাকে সন্তান থেকে দিয়ত দিচ্ছিলেন। কিন্তু সন্তানকে পিতা থেকে দিয়ত দিচ্ছিলেন না।- সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ১৩৯৯
ইমাম তিরমিজী বলেন হাদীসটির সনদ সহীহ নয়। হাদীসটির মধ্যে এযতেরাব রয়েছে। তবে আহলে ইলমদের আমল উক্ত হাদীসের উপর চালু রয়েছে যে, পিতা তার সন্তানকে হত্যা করলে কেসাস নেওয়া হয় না এবং অপবাদ দিলে শাস্তি প্রয়োগ করা হয় না।
ঘ) القاتل لا يرث
অর্থঃ হত্যাকারী মীরাছ পায় না।- সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ২১০৯
ইমাম তিরমিজী বলেন হাদীসটি সহীহ নয়। উল্লেখিত সূত্র ব্যতীত হাদীসটি অন্য কোন ভাবে জানা যায় না। তবে আহলে ইলমদের আমল উক্ত হাদীসটির অনুকুলে।
উপরে আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, যখন কোন হাদীসকে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীন যঈফ সাব্যস্ত করেন আর কিছু মুহাদ্দিসীন সহীহ সাব্যস্ত করেন তখন হাদীসটি সহীহ সাব্যস্তকরণে যারা যঈফ বলেছেন তাদের বক্তব্য কোন প্রভাব ফেলবে না। কেননা যারা হাদীসটিকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন তারা এই দিকটি বিবেচনা করেছেন যে হাদীসটির সনদ সমূহের মধ্য থেকে কোন সনদই আপত্তি থেকে খালি নয়। আর যারা হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন তারা উম্মতের হাদীসটিকে কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করা এবং হাদীসটির সনদগুলোর সমষ্টিগত বিচারে তা বলেছেন।
বরং আমাদের নিকট কোন হাদীসকে উম্মত কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহন করলে তা মুতাওয়াতের এর পর্যায়ে পৌছে যায়। আল্লামা জাসসাস (রহঃ) আহকামুল কুরআনে বলেন-
وقد استعملت الأمة هذين الحديثين في نقصان العدة، وإن كان وروده من طريق الآحاد، فصار في حيز التواتر; لأن ما تلقاه الناس بالقبول من أخبار الآحاد فهو عندنا في معنى المتواتر لما بيناه في مواضع،
অর্থঃ এই দুটি হাদীসকে উম্মত আমলে নিয়েছেন যদিও তা খবরে ওয়াহেদের (একক সূত্রের) ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে। এটা মুতাওযাতের এর মত হয়ে গিয়েছে। কেননা কোন খবরে ওয়াহেদকে যখন উম্মত কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তখন তা মুতাওয়াতের এর পর্যায়ে পৌছে যায়। এর কারণে আমার একাধিক স্থানে বর্ণনা করেছি। – আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/৩৮৬
উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস অনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) বলেন-
وهذا الحديثُ ضعيفٌ باتفاق مع ثبوت حُكْمه بالإِجماع وذهب بعضُهم إلى أن الحديثَ إذا تأيَّد بالعملِ ارتقى من حال الضَّعْف إلى مرتبة القبول قلت: وهو الأَوْجَهُ عندي وإن كَبُر على المشغوفِين بالإِسناد واعتبارُ الواقع عندي أولى مِن المَشْي على القواعد (انتهي بتقديم و تاخير يسير)
অর্থঃ ওয়ারিশের জন্য কোন ওসিয়ত নেই” হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে যঈফ তবে তার হুকুম প্রমাণীত হওয়ার ব্যপারে সকলে একমত। তিনি আরো বলেন উলামাদের একটি দল বলেছেন কোন হাদীস যখন (উম্মতের) আমল দ্বারা শক্তিশালী হয় তখন তা দূর্বল অবস্থা থেকে কবূলের স্তরে পৌছে যায়। আর এটাই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়। যদিও তা যারা সনদ নিয়ে গবেষণা করেন তাদের জন্য ভারি হয়ে উঠে। বাস্তবতার বিবেচনা আমার নিকট নীতির উপর চলার চেয়ে উত্তম। – ফয়জুল বারী ৩/৪০৯
সার কথা কোন হাদীস সনদিক বিচারে যঈফ হলেই তা আমলযোগ্য নয় এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। বরং কোন হাদীস যঈফ হলেও যদি উম্মত তা কবূলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে উক্ত হাদীসের উপর উলামায়ে কেরামের আমল চালু থাকে তবে এটাই উক্ত হাদীসকে সহীহ সাব্যস্ত করবে। যেমনটি উপরে উল্লেখিত পাহাড় সমতুল্য এক ঝাক পূর্ববতি মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।