আল্লাহ তাআলা বান্দাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আসার জন্য, তার নৈকট্য প্রাপ্ত হওয়ার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য বছরে বিশেষ বিশেষ কিছু দিন রেখেছেন। যে দিন গুলো যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে বান্দা আল্লাহ তাআলার ক্ষমার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এ দিন গুলোতে আল্লাহ তাআলা তার মাগফেরাতের সাগরের পাহাড়সম উত্তাল ঢেউয়ের দ্বারা বান্দাকে গুনাহ থেকে এমন ভাবে ধুয়ে মুছে পবিত্র করেন যে, কেমন যেন সে সদ্যজাত নিষ্পাপ সন্তানের ন্যায় হয়ে যায়। এ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দিন হচ্ছে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত। শব বা লাইলাহ শব্দের অর্থ হল রাত। আর বরাত শব্দটির আসল রূপ হল বারাআত। যার অর্থ মুক্তি। কাজেই এর অর্থ দাড়ায় মুক্তির রাত। কেননা এ রাতে আল্লাহ তাআলা তার অসংখ্য, অগণিত বান্দাকে ঢালাওভাবে মাফ করে দেন।
এ রাতকে কেন্দ্র করে যেমনিভাবে পরিলক্ষিত হয় সীমালংঘন বা অতিরঞ্জন তেমনিভাবে শিথিলতা বা ছাড়াছাড়ি। অথচ বাস্তবতা ও হক উভয়ের মাঝামাঝি। এ রাতকে কেউ কেউ হালুয়া রুটি বা ভালমন্দ খাওয়ার উৎসব, কেউ আলোকসজ্জা ও আনন্দ ফুর্তি করার রাত কেউবা সারারাত নফল ইবাদত করে ফজরের জামাআত তো দূরের কথা নামাযই ক্বাযা করে দেওয়ার রাত মনে করেছেন। অন্য দিক থেকে কেউ কেউ এ রাতের ফযীলতকেই অস্বীকার করে বসেছেন। এ রাতে কোন ইবাদত-বন্দেগী নেই, এ রাতের আলাদা কোন বৈশিষ্ট বা মর্যাদা নেই বলে লিফলেট বিতরণ করে উম্মতকে বঞ্চিত করেন। অথচ ইসলাম উভয় প্রকার প্রান্তিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনিতেই শাবান মাসকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لَا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لَا يَصُومُ فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ
অর্থ: হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে (নফল) রোযা রাখতেন যে, আমরা ধারণা করতাম তিনি আর রোযা ছাড়বেন না। আবার তিনি (নফল) রোযা রাখতেন না এমনকি (তার এই অবস্থা দেখে) আমরা ধারণা করতাম তিনি আর (নফল) রোযা রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমযান ব্যতীত অন্য কোন মাসে পরিপূর্ণভাবে রোযা রাখতে দেখিনি। আর শাবান মাসের ন্যায় অধিক রোযা রাখতে কখনো দেখিনি।-সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৭৯।
অন্য হাদীসে রয়েছে-
عَنْ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْرًا مِنْ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ قَالَ ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الْأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ
অর্থঃ হযরত উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি শাবান মাসে, য়ে পরিমান রোযা রাখেন অন্য কোন মাসে আপনাকে এত রোযা রাখতে দেখি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তা রজব ও রমযানের মাঝে এমন একটি মাস, মানুষ যে সময় গাফেল থাকে। আর তা এমন একটি মাস যে মাসে সমস্ত জগতের পালনকর্তার নিকট আমল পেশ করা হয়। আমি পছন্দ করি আমার আমল (আল্লাহ তাআলার নিকট) এমন অবস্থায় পেশ করা হোক যে, আমি রোযাদার।-সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং ২৩৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২১৭৫৩
উপরোক্ত দুটি হাদীস এবং এ ধরণের আরো অসংখ্য হাদীস দ্বারা এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝে আসে যে, শাবান মাসের প্রতিটি দিনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিন গুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত যত্নবান হতেন। যার ব্যপকতার দ্বারা শবে বরাতের মহত্ত্বও শামিল হয়ে যায়। এছাড়াও নির্দিষ্টভাবে এ রজনীর ফযীলত একাধিক হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু হাদীস পেশ করা হল-
১।عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
অর্থঃ হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) তার সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।–সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৫৬৬৫; তাবারানী, আলমুজামুল আওসাত, হাদীস নং ৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবীর ১৫/১০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৯০; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৬৬২৮
হাদীসটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ। ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব হাম্বলী, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্‌তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮ ও ৩/৪৫৯; লাতায়েফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৫১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১।
শবে বরাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যদি অন্য কোন হাদীস নাও থাকতো তবে এই একটি হাদীসই যথেষ্ট হত। অথচ হাদীসের বিশাল ভান্ডারে নির্ভরযোগ্য সনদে এ সংক্রান্ত আরো একাধিক রেওয়ায়েত রয়েছে।
২।عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَطَّلِعُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى خَلْقِهِ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ إِلَّا لِاثْنَيْنِ مُشَاحِنٍ وَقَاتِلِ نَفْسٍ
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) তার সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুশরিক এবং হত্যাকারী এই দুইজন ব্যতীত তার (সকল) বান্দাদেরকে মাফ করে দেন।–মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৬৬৪২
লাতায়েফুল মাআরিফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইয়াসীন বলেন হাদীসটি সনদ সহীহ। নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেব হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।-(সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ৩/২১৮)
عن أبي ثعلبة الخشني عن النبي صلى الله عليه و سلم قال إذا كان ليلة النصف من شعبان اطلع الله إلى ৩।
خلقه فيغفر للمؤمن و يملي للكافرين و يدع أهل الحقد بحقدهم حتى يدعوه
অর্থঃ হযরত আবূ ছালাবা বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন অর্ধ-শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) আসে আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুমিনকে মাফ করে দেন এবং কাফেরদেরকে অবকাশ দেন। আর হিংসুককে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন যতক্ষণ না তারা হিংসা ছেড়ে দেয়।–বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩২; তাবারানী, আলমুজামুল কাবীর ১৬/২২০
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) হাদীসটির ব্যাপারে বলেন-
هو أيضا بين مكحول و أبي ثعلبة مرسل جيد
অর্থঃ মাকহূল ও আবূ ছালাবার মাঝে এটা একটি উত্তম মুরসাল বর্ণনা।
৪। عن أبي بكر عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ينزل الله إلى السماء الدنيا ليلة النصف من شعبان فيغفر لكل شيء إلا رجل مشرك أو رجل في قلبه شحناء
অর্থঃ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) পৃথিবীর নিকটস্থ আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর মুশরিক এবং যার অন্তরে হিংসা রয়েছে এমন ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন।–বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮২৭
হাফেয হাইছামী (রহঃ) উক্ত সনদে উপরোক্ত হাদীসের ন্যায় একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেন-
رواه البزار وفيه عبد الملك بن عبد الملك ذكره ابن أبي حاتم في الجرح والتعديل ولم يضعفه وبقية رجاله ثقات
অর্থঃ হাদীসটি ইমাম বাযযার রেওয়ায়েত করেছেন। তার সনদে আব্দুল মালিক ইবনে আব্দুল মালিক রয়েছে। ইবনে আবী হাতেম তাকে “আলজারহু ওয়াত তাদীলে” নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন কিন্তু তাকে যয়ীফ বলেননি। আর হাদীসটির অন্য সকল রাবী ছেকাহ (নির্ভরযোগ্য)।–মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/১২৫
عن عثمان بن أبي العاص عن النبي صلى الله عليه و سلم قال إذا كان ليلة النصف من شعبان فإذا مناد ৫।
هل من مستغفر فاغفر له هل من سائل فأعطيه فلا يسأل أحد إلا أعطي إلا زانية بفرجها أو مشرك
অর্থঃ হযরত উসমান ইবনে আবীল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন অর্ধ-শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) হয় একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে, আছে কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কোন যাচনাকারী? আমি তাকে (তার চাওয়া বস্তু) দান করব। এভাবে যে-ই কোন কিছু চায় তাকে তা দেওয়া হয় তবে লজ্জাস্থান দ্বারা যিনাকারী ও মুশরিক ব্যতীত।-বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৬
عن عائشة قالت فقدت النبي صلى الله عليه و سلم ذات ليلة فخرجت أطلبه فإذا هو بالبقيع رافع رأسه ৬। إلى السماء فقال يا عائشة أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله؟ قالت قد قلت وما بي ذلك ولكني
ظننت أنك أتيت بعض نسائك فقال إن الله تعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب
অর্থঃ আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন এক রাতে আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (বিছানায়) না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম। আমি দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে, তাঁর মাথা আকাশের দিকে উত্তোলন করে আছেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হে “আয়েশা। তুমি কি এই আশংকা করছ যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার উপর অবিচার করবেন? “আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, এতো আমার জন্য আদৌ সমীচীন নয়। বরং আমি মনে করেছি, আপনি আপনার অপর কোন বিবির কাছে গেছেন। তখন তিনি বললেন, মহান আল্লাহ ১৫ই শা’বানের রাতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমের চাইতেও অধিক লোককে ক্ষমা করেন।–সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৯; সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং ৭৩৯; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৬০১৮
৭। عن عائشة قالت قام رسول الله صلى الله عليه و سلم من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد
قبض فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع إلي رأسه من السجود و فرغ من صلاته قال يا عائشة أو يا حميراء أظننت أن النبي قد خاس بك قلت لا و الله يا رسول الله و لكنني ظننت
أنك قبضت لطول سجودك فقال أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت الله و رسوله أعلم قال هذه ليلة النصف من شعبان إن الله عز و جل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين و يرحم المسترحمين
و يؤخر أهل الحقد كما هم
অর্থঃ হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।– বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৫
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-
هذا مرسل جيد
অর্থঃ এটি একটি উত্তম মুরসাল বর্ণনা।
এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, এ রাতে লম্বা সিজদা বিশিষ্ট দীর্ঘ নফল নামায পড়া শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।
৮। عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال قال رسول الله إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينزل فيهالغروب الشمس الى سماء الدنيا فيقول ألا من مستغفر؟ فاغفرله ألا مستزرق؟ فأرزقه ألا مبتلى؟ فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر
অর্থঃ হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অর্ধ শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্‌হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৮
এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। তবে মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত মত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য।
শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ জাল। শায়খ আলবানীর উক্ত সঠিক নয়। বরং উক্ত রেওয়ায়েতটি ‘যয়ীফ’ তথা দুর্বল। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন। উক্ত রেওয়ায়েত সম্পর্কে আলবানী সাহেবের আপত্তি হল, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী সাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজু’ হওয়া উচিত। কিন্তু তার এ দাবিটি সঠিক নয়। কেননা ইবনে আবী সাবুরা সম্পর্কে বেশি থেকে বেশি এতটুকু বলা যায় যে, যয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী (রাহঃ) পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০
উপরোক্ত হাদীসগুলো ছাড়াও হাদীসের কিতাব সমূহে এ রাতের ফযীলত সম্বলিত অসংখ্য রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। যেগুলোর কোনটি হাসান লিযাতিহী, কোনটি হাসান লিগাযরিহী। আর উলূমুল হাদীসে বিচরণকারী ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, হাসান মূলত সহীহ হাদীসেরই একটি প্রকার। এছাড়াও বেশ কিছু যয়ীফ রেওয়ায়েতও রয়েছে।

উপরের হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ রাতে আল্লাহ তাআলার রহমত ও মাগফেরাতের দরজা খুব ব্যপকভাবে উন্মুক্ত হয়। এ রাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য অগণিত মানুষকে ঢালাওভাবে মাফ করে দেন। হাদীসের ভাষ্য মতে বনূ কালব গোত্রের হাজার হাজার ভেড়ার পশমের চেয়েও অধিক মানুষকে আল্লাহ তাআলা এ রাতে মাফ করে দেন। এখন এগুলো জানার পরে বান্দার কি করা উচিত? কোন আমল না করে চুপচাপ বসে থাকবে? আসলে কোন বিশেষ সময় বা দিনে যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফেরাতের ঘোষণা হয় তখন বান্দার কর্তব্য হল, সে ঐ সকল আমলের ব্যপারে খুব যত্নবান হবে যেগুলো করলে বান্দা আল্লাহ তাআলার রহমত, মাগফেরাত এবং সাধারণ ক্ষমার যোগ্য ও উপযুক্ত হয়। আর ঐ সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে যেগুলোর কারণে বান্দা রহমত ও মাগফেরাত থেকে বঞ্চিত হয়।

কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হল, আমাদের তথাকথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করে থাকেন। তারা বলেন, এ রাতের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। এ রাতের ফযীলত সম্পর্কিত যে সকল রেওয়ায়েত রয়েছে তার সব গুলোই দুর্বল বা জাল। এ সংক্রান্ত লিফলেট তারা ব্যপক ভাবে বিতরণ করে থাকে। নির্ভরযোগ্য সনদে (যেখানে একাধিক সহীহ ও হাসান হাদীস রয়েছে) এতগুলো হাদীস বর্ণিত হওয়ার পরেও সবগুলোকে দুর্বল বা জাল বলা কি হাদীস অস্বীকার করার মধ্যে গণ্য হয় না? অবাস্তব, অবান্তর কথা ও লিফলেট প্রচার করে এ রাতের অসাধারণ কল্যান ও বরকত থেকে উম্মতকে বঞ্চিত করার প্রয়াস চালানো কি কোন মুমিনের কাজ হতে পারে? আহলে হাদীস ভাইয়েরা যাদেরকে বিশেষভাবে ইমাম ও অনুসরণীয় মানেন (যেমন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, আব্দুর রহমান মোবারকপুরী প্রমুখ) তারাও এ রাতের ফযীলতকে উল্লেখিত রেওয়ায়েতগুলোর জন্য অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এ রাতটিকে বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। আসলে ইলমে হাদীসের ময়দানে যার সামান্যতম বিচরণ রয়েছে তিনি এ রজনীর ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন না।
শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী আমাদের ১ নং বর্ণিত হযরত মুআয ইবনে জাবালের হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন-
حديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف
ابن مالك و عائشة
অর্থঃ সহীহ হাদীস। হাদীসটি বিভিন্ন সনদে সাহাবায়ে কেরামের একটি জামাআত থেকে বর্ণিত হয়েছে। যেগুলোর একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। তারা হলেন মুআয বিন জাবাল, আবূ ছালাবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আবূ মূসা আশআরী, আবূ হুরাইরা, আবূ বকর সিদ্দীক, আউফ ইবনে মালেক এবং আয়েশা (রাঃ)।
এরপর তিনি এই আটজনের হাদীস বিস্তারিত উল্লেখ করার পর বলেন-
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلاريب. والصحة تثبت بأقل منها عددا، مادامت سالمة من الضعف الشديد، كماهو الشأن فى هذاالحديث
অর্থঃ সারকথা হল, এ সব রেওয়ায়েতের মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়। সহীহ এর চেয়ে কম সংখ্যার দ্বারাই সাব্যস্ত হয় যতক্ষণ তা মারাত্মক দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকে। যেমনটি এই হাদীসের অবস্থা।- সিলসিলাতুল আহাদীসিস্‌ সহীহাহ ৩/১৩৫-১৩৯
তারপর আলবানী (রহঃ) ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন, যারা কোন ধরণের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীমে বলেন –
ومن هذا الباب ليلة النصف من شعبان فقد روى في فضلها من الأحاديث المرفوعة والآثار ما يقتضي أنها ليلة مفضلة
অর্থঃ আর এরই অন্তভুক্ত অর্ধ শাবানের রাত্রি। এ ব্যপারে বেশ কিছু এমন মারফূ রেওয়ায়েত ও আসার বর্ণিত রয়েছে যেগুলো দাবী করে এটা একটি ফযীলতপূর্ণ রাত্রি।-ইক্‌তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৯৭ (শামেলা)
তিরমিজী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা গ্রন্থ তোহফাতুল আহওয়াযীতে আব্দুর রহমান মোবাকরপুরী (রহঃ) বলেন-
اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلاً
অর্থঃ জেনে রাখ, অর্ধ শাবানের রাত্রির ফযীলতের ব্যপারে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যে গুলো সমষ্টিগত ভাবে প্রমান করে যে, তার একটি ভিত্তি রয়েছে।
এরপর তিনি বেশ কিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করে বলেন-
فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء
অর্থঃ কাজেই সমষ্টিগত বিচারে এ হাদীসগুলো তাদের বিরুদ্ধে দলীল যারা বলেন যে, শাবানে অর্ধ রাত্রির ফযীলতের ব্যপারে কোন হাদীস নেই।-তোহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৬৫-৩৬৭
আমাদের যে সকল আহলে হাদীস বা সালফী ভাইয়েরা এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করত লিফলেট বিতরণ করেন তাদের শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্‌তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম ২/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ এর তাহকীক গভীরভাবে লক্ষ্য করা উচিত। আর ইনসাফের সাথে ভাবা উচিত কোন অনুসরনযোগ্য? তাদের দলীল নির্ভর তাহকীক না কি খামখেয়ালি বক্তব্য?
সারকথা, শবে বরাতের ফযীলত নির্ভরযোগ্য একাধিক হাদীস দ্বারা বর্ণিত। প্রত্যেক মুমিনের এ রাতে সাধ্যমত নামায, যিকির, তিলাওয়াত, ইস্তেগফার প্রভৃতি ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটানো উচিত, যাতে সে এ রাতের বরকত ও কল্যান পেতে পারে এবং সাধারণ ক্ষমার উপযুক্ত হতে পারে। এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা এবং এ বিষয়ের সকল হাদীসকে মওযু বা জাল বলা যেমনিভাবে ভুল তেমনি ভাবে এ রাতকে শবে কদরের রাতের ন্যায় বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করা মূর্খতা।

এ রাতে বা দিনে যে সকল আমল করা যায়ঃ

সম্মিলিত কোন রূপ না দিয়ে এবং মনগড়া নির্ধারিত কোন পদ্ধতি অবলম্বন না করে এ রাতে সাধ্যমত যে কোন নফল ইবাদত করা যায়। যেমন দীর্ঘ নফল নামায (যেমনটি হাদীস শরীফ থেকে বুঝে আসে), কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, তাওবা-ইস্তেগফার, দুআ ইত্যাদি।
পরের দিন রোযা রাখা। যদিও হাদীস শরীফে এ রোযার বিশেষ কোন ফযীলত বর্ণিত হয়নি।
উসতাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব (দাঃবাঃ) এ বিষয়ে লেখেন-
“সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে
عن على بن ابى طالب رضى الله عنه قال : قال رسول الله إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها, فإن الله ينزل فيهالغروب الشمس الى سماء الدنيا, فيقول : ألا من مستغفر فاغفر له على مستزرق فأرزقه, ألا مبتلى فأعافيه , ألا كذا, ألا كذا, حتى يطلع الفجر
অর্থঃ হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্‌হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৮৮
এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। কিন্তু মুহাদ্দিসীন কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীয অর্থাৎ প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টিও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
বলা বাহুল্য, পনের শাবানের দিনটি শাবান মাসেরই একটি দিন এবং তা আয়্যামে বীযের অন্তর্ভূক্ত। এজন্য ফিক্‌হের একাধিক কিতাবেই এদিনে রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনূন লেখা হয়েছে। আবার অনেকে বিশেষভাবে এ দিনের রোযাকে মুস্তাহাব বা মাসনুন বলতে অস্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ত্বাকী উসমানী (দাঃ বাঃ) তার ইসলাহী খুতুবাতে বলেন, ‘আরো একটি বিষয় হচ্ছে শবে বরাতের পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখা। গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদীসে রাসুলের বিশাল ভান্ডার হতে একটি মাত্র হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ।‘ সনদ বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোযাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতে অনুচিত।’

তবে হ্যাঁ, শাবানের গোটা মাসে রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোযা রাখতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বারণ করেছেন। ইরশাদ করেন, রমযানের দুএকদিন পূর্বে রোযা রেখো না। যাতে রমযানের পূর্ণ স্বস্তির সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ।
একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, শাবানের এই ১৫ তারিখটি তো ‘আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভূক্ত। আর নবীজী প্রতি মাসের আইয়ামে বীয এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি এই দুটি কারণকে সামনে রেখে শাবানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা আইয়ামে বীয এর অন্তর্ভূক্ত, পাশাপাশি শাবানেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন, তবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই সে প্রতিদান লাভ করবে। তবে শুধু ১৫ শাবানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নাত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় মুহাররমের ১০ তারিখ ও আইয়ামে আরাফা (যিলহজ্জের ৯ তারিখ) এর কথা উল্লেখ করেছেন অথচ শাবানের ১৫ তারিখের কথা পৃথকভাবে কেউই উল্লেখ করেননি। বরং তারা বলেছেন, শাবানের যে কোন দিনই রোযা রাখা উত্তম। সুতরাং এ সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে যদি কেউ রোযা রাখে তরে ইংশাআল্লাহ সে ছাওয়াব পাবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, রোযা রাখার ব্যাপারে এ মাসের নির্দিষ্ট কোন দিনের পৃথক কোন বৈশিষ্ট নেই”।(সূত্রঃ মাসিক আলকাওসার, সেপ্টেম্বর ২০০৫)

এ রাতের বর্জণীয় বিষয় সমূহঃ

১। আলোকসজ্জা করা, বাজি বা পটকা ফুটানো এগুলো নাজায়েয। এগুলোর মধ্যে যেমন অপচয় রয়েছে তেমনি ভাবে বিজাতীদের অনুসরণ।
২। হালুয়া রুটির আয়োজন করা, রসম বা ছাওয়াবের কাজ মনে করে ভাল খান পিনার ব্যবস্থা করা।
৩। জামাআতের সাথে সালাতুল তাসবীহ, তাহাজ্জুদ বা নফল নামায পড়া। জামাআতের সাথে যে কোন নফল নামায পড়া জায়েয নয়। বরং একাকী পড়বে।
৪। নির্ধারিত কোন পদ্ধতিতে নামায পড়া, যেমন নামাযে অমুক অমুক সূরা পড়া, এত রাকাআত পড়া, অমুক সুরা এত বার পড়া ইত্যাদি। এ সংক্রান্ত যত রেওয়ায়েত রয়েছে সবগুলোই মওজু। ইবনে দিহয়া (রহঃ) বলেন-
أحاديث صلاة البراءة موضوعة
অর্থঃ শবে বরাতের বিশেষ নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো মওজু।-তাযকিরাতুল মওযূআত, মুহাম্মাদ তাহের পাটনী পৃ. ৪৫
এ রাতের নামাযের নির্ধারিত কোন নিয়ম নেই। দুই দুই রাকাআত করে নফলের নিয়তে যত রাকাআত ইচ্ছা যে সূরা ইচ্ছা পড়া যায়।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনৌবী (রহঃ) বলেন-
‘শবে বরাতে রাত্রি জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয় তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাআত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো মওযূ। তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।’ -আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ, পৃষ্ঠা ৮০-৮৫
৫। গোরস্থানে যাওয়া এবং কবর যিয়ারত করা। এ ব্যাপারে উপমহাদেশের অন্যতম হাদীস বিশারদ মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব (দাঃ বাঃ) বলেন-
“কবরস্থান যদি নিকটবর্তী হয় এবং মাযার না হয় আর সেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কাজকর্ম না হয় তাহলে পুরুষের জন্য এ রাতে সেখানে গিয়ে যিয়ারত করার বিধান কী? হাকীমুল উম্মত থানভী (রাহঃ) প্রথমে একে মাসনূন লিখেছিলেন। পরে আরো চিন্তা-ভাবনা ও উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মত বিনিময় করার পর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন এবং লেখেন যে, আমি কবরস্থানে যাওয়া থেকে বারণ করাকেই অধিক সতর্কতার বিষয় মনে করি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৮) শরীয়তের নীতিমালার আলোকে হযরত থানভী (রাহঃ) এর দ্বিতীয় মতই অগ্রগণ্য।(সূত্রঃ মাসিক আলকাওসার, আগস্ট ২০০৮)
৬। মাইকে ওয়াজ, কুরআন তিলাওয়াত ও শবীনা পড়া। এগুলোও নিষিদ্ধ। এর দ্বারা ইবাদাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এবং মাযূরদের কষ্ট হয়।
অনেক জায়গায় দেখা যায় এ রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ওয়াজ নসীহত চলতে থাকে। ফলে ওয়াজ শুনতে শুনতে অনেক মানুষের ইবাদাতের আগ্রহ শেষ হয়ে যায়। আর এটা যখন মাইকে হয় তখন তা আরো কঠিন হয়ে দাড়ায়। তখন না আগ্রহী মানুষের ঘরে বসে ইবাদাত করা সম্ভব হয় না মসজিদে। তাই এগুলো পরিত্যজ্য। তবে বর্তমানে মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা ও দ্বীনী চেতনাহীনতা এত চরমে পৌছে গিয়েছে যে, অধিকাংশ মানুষই এর বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ। এর পাশাপাশি কিছু জাহেল মানুষের অপতৎপরতা তো রয়েছেই। আবার এ রাতের পূর্বে মানুষকে একত্রিত করাও মুশকিল। কিন্তু জনসাধারণের মাঝে এ দিনের আযমত পুরপূর্ণ মাত্রায় থাকায় এ দিনে মসজিদে সমবেত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তাই ইশার আগে বা পরে ইমাম সাহেব যদি এ রাতের বাস্তবতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জনসাধারনকে অবহিত করে, বিশেষকরে আল্লাহ তাআলার সাধারণ ক্ষমা সংক্রান্ত দুএকটি হাদীস বলে দেয় তবে তা উত্তম হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

যাদেরকে এ রাতে ক্ষমা করা হবে নাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا ينظر الله فيها إلى مشرك و لا إلى مشاحن و لا إلى قاطع رحم و لا إلى مسبل و لا إلى عاق لوالديه و لا إلى مدمن خمر
অর্থঃ আল্লাহ তাআলা এই রাতে মুশরিকের প্রতি, হিংসুকের প্রতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর প্রতি, টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা (পুরুষদের) প্রতি, পিতামাতার অবাধ্যের প্রতি এবং শরাব পানকারীর প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন না (অর্থাৎ এদেরকে মাফ করেন না)।–বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৭
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَطَّلِعُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى خَلْقِهِ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ إِلَّا لِاثْنَيْنِ مُشَاحِنٍ وَقَاتِلِ نَفْسٍ
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) তার সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুশরিক এবং হত্যাকারী এই দুইজন ব্যতীত তার (সকল) বান্দাদেরকে মাফ করে দেন।–মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৬৬৪২
অন্য হাদীসে রয়েছে-
عن عثمان بن أبي العاص عن النبي صلى الله عليه و سلم قال إذا كان ليلة النصف من شعبان فإذا مناد
هل من مستغفر فاغفر له هل من سائل فأعطيه فلا يسأل أحد إلا أعطي إلا زانية بفرجها أو مشرك
অর্থঃ হযরত উসমান ইবনে আবীল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন অর্ধ-শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) হয় একজন আহ্বানকারী বলতে থাকে, আছে কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কোন যাচনাকারী? আমি তাকে (তার চাওয়া বস্তু) দান করব। এভাবে যে-ই কোন কিছু চায় তাকে তা দেওয়া হয় তবে লজ্জাস্থান দ্বারা যিনাকারী ও মুশরিক ব্যতীত।-বাইহাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৮৩৬
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝে আসে যে, এ রাতে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরকে মাফ করা হবে না-
১। যে ব্যক্তি শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত।
২। যারা অন্যের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ পোষন করে।
৩। হত্যাকারী।
৪। যে যিনা করে।
৫। যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে।
৬। যে সকল পুরুষ টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে।
৭। পিতা-মাতার অবাধ্যকারী।
৮। যারা শরাব পান করে ইত্যাদি।
উপরোক্ত গুনাহ সমূহে যারা অভ্যস্ত, তারা এ রাতে সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত হবে না। তাই প্রত্যেক মুনিনের উচিত বিশেষ করে উক্ত গুনাহ সমূহ থেকে বরং সমস্ত গুহান থেকে বেঁচে থাকা। কেউ এগুলোতে আক্রান্ত হলে খালেছভাবে তাওবা করে এবং এগুলো থেকে মুক্ত হয়ে এ রাতে ক্ষমার উপযুক্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেন-
‘মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেছ দিলে তওবা করে যিকির, দুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যানের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ছাওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনের তারিখের রোযাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবগুলোই কবীরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হল সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’-লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬

Loading