যে সকল সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়ঃ
স্বর্ণ,রুপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসার পন্য এই চারটি জিনিষের উপর যাকাত আসে। কিছু জন্তুর উপরেও যাকাত আসে। তবে যেহেতু ঐ সকল জন্তুর উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলী আমাদের দেশে সাধারণত পাওয়া যায় না তাই এখানে তা উল্লেখ করা হল না। এর পরেও ঐ সকল জন্তুর যাকাত প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা পরে করা হবে ইনশাআল্লাহ।
মাসআলাঃসোনা-রূপা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন তা যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে। চাই তা বিস্কুট আকারে থাকুক বা মুদ্রা হিসেবে থাকুক বা অলংকার হিসেবে থাকুক বা পাত্র হিসেবে থাকুক।
মাসআলাঃ সোনা ও রুপা যদি খাঁটি না হয় বরং তাতে অন্য ধাতু মিশ্রিত থাকে তবে বেশি অংশ সোনা বা রুপা হলে তা পুরোটাই সোনা বা রুপা হিসেবে ধর্তব্য হবে। নেসাব পরিমান হলে যাকাত দিতে হবে। আর যদি খাঁদ বা অন্য ধাতু বেশি পরিমান হয় তবে তা ঐ অন্য ধাতু হিসেবে গন্য হবে। ব্যবসা ব্যতীত উক্ত ধাতুতে যাকাত আসবে না।
মাসআলাঃ সোনা-রূপা ব্যাতিত অন্যান্য ধাতুর অলংকার যত মূল্যবানই হোক না কেন ব্যবসার নিয়ত ব্যতীত তা যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে না।
মাসআলাঃ ফসলী জমি, বাড়ি নির্মাণের জন্য ক্রয়কৃত জমি এবং এমনিতে ফেলে রাখা জমির উপর যাকাত ফরজ নয়। তবে এগুলো ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করলে যাকাত দিতে হবে যদি নেসাব পরিমান হয়।
মাসআলাঃ কারো একাধিক বাড়ি রয়েছে। তার উদ্দেশ্য হল ভাড়া খাটিয়ে টাকা অর্জন। তবে উক্ত বাড়ীগুলোর মূল্যের উপর যাকাত আসবে না। তবে ভাড়া বাবদ অর্জিত টাকার উপর যাকাত আসবে যদি নেসাব পরিমান হয়। অনুরূপভাবে থাকার জন্য নির্মাণকৃত বাড়ির উপরেও যাকাত আসে না।
মাসআলাঃ মিল, কলকারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যে সকল আসবাব রাখা রয়েছে সেগুলোর উপর যাকাত ফরজ নয়। কেননা এ সকল জিনিষ বিক্রি করা হয় না। তবে মেশিন থেকে উৎপন্ন পন্যের উপর যাকাত আসবে। অনুরূপভাবে কারখানায় যে সকল কাঁচামাল বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে তার উপরও যাকাত আসবে। যেমন গার্মেন্টস এ জামা-কাপড়, সুতা, বোতাম, চেইন ইত্যাদি। কাজেই এগুলোর উপর যাকাত আসবে।
মাসআলাঃ সোনা-রূপা ব্যতীত অন্য কোন বস্তু হস্তগত হওয়ার সময় ব্যবসা বা বিক্রির নিয়ত ছিল না। পরবর্তীতে সে উক্ত বস্তুতে বিক্রি বা ব্যবসার নিয়ত করল। তবে শুধুমাত্র এই নিয়তের কারনেই উক্ত বস্তু যাকাতযোগ্য সম্পদে রূপান্তরিত হবে না। বরং যখন উক্ত বস্তু বিক্রি করা হবে এবং তার বিনিময় হস্তগত হবে তখন তার উপর যাকাত আসবে যদি সে নেসাবের মালিক হয়।
মাসআলাঃ যে সকল যানবাহন ( রিক্সা, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, জাহাজ ইত্যাদি ) ভাড়ায় খাটানো হয় অথবা উপার্জনের উদ্দেশ্যে গ্রহন করা হয় তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। বরং এগুলোর আয়ের উপর যাকাত আসবে। তবে এসব যানবাহন বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করে থাকলে এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত আসবে। অনুরূপভাবে ব্যবহারের জন্য ক্রয়কৃত যানবাহনের উপর যাকাত আসবে না। চাই তা যত বেশি ও দামীই হোক না কেন।
মাসআলাঃ মোটা-তাজাকরনের পর বিক্রির উদ্দেশ্যে যে জানোয়ার ক্রয় করা হয় তার মূল্যের উপর যাকাত আসবে।
মাসআলাঃ সরকারী বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের জি,পি ও সি,পি ফান্ডের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে যে অংশ কেটে রাখা হয় তা হস্তগত হওয়ার পূর্বে তার উপর যাকাত ওয়াজিব নয়। হস্তগত হওয়ার পর যদি সে পূর্ব থেকে নেসাবের মালিক না হয় আর উক্ত ফান্ড নেসাব পরিমাণ হয় তবে উক্ত টাকার উপর এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। আর যদি পূর্ব থেকে নেসাবের মালিক হয়ে থাকে তবে ঐ টাকার যাকাত দেওয়ার সময় উক্ত ফান্ডেরও যাকাত দিতে হবে। তবে সরকারী বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে যে অংশ ( চাই কিছু অংশ হোক বা পুরো অংশ) ঐচ্ছিকভাবে কর্তন করা হয় তার উপর যাকাত আসবে।
মাসআলাঃ বিভিন্ন পেশাজীবীরা তাদের পেশায় যে সকল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। যেমন- কৃষকের ট্র্যাক্টর,রাজমিস্ত্রির হাতুড়ি,বেলচা ইত্যাদি।
মোট কথা এক্ষেত্রে মূলনীতি হল সোনা-রুপা,নগদ টাকা ও ব্যবসার মাল ব্যতিত যত সম্পদ রয়েছে তা যত বেশি দামী হোক না কেন তার উপর যাকাত আসে না। আর সোনা-রুপা ব্যতীত যে কোন সম্পদ যখন তা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয় যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসেবে ধর্তব্য হবে।
উল্লেখ্য যে, পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে গরু-ছাগল ইত্যাদি ও ফসলের যাকাত সম্পর্কে পরে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
যাকাতের নেসাবঃ
যদি কারো নিকট (১)সাড়ে সাত তোলা পরিমান সোনা থাকে অথবা (২)সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা থাকে অথবা (৩)সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার যে কোন একটির মূল্যের সমপরিমান টাকা-পয়সা বা ব্যবসার মাল থাকে অথবা (৪)যাকাতযোগ্য চারটি (সোনা, রুপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসার মাল) সম্পদই থাকে যার সমষ্টিগত মূল্য উপরোক্ত পরিমান সোনা বা রুপার যে কোন একটির মূল্যের সমপরিমান হয় অথবা (৫) যাকাতযোগ্য যে কোন তিনটি বা দুটি সম্পদ থাকে যার সমষ্টিগত মূল্য উপরোক্ত পরিমান সোনা বা রুপার (সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা) যে কোন একটির মূল্যের সমপরিমান হয়, তবে সে নেসাবের মালিক হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং বছরান্তে তার উপর যাকাত ফরজ হবে।
মাসআলাঃ শুধু সোনা থাকলে যাকাতের নেসাব হল সাড়ে সাত তোলা (ভরি) স্বর্ণ।
মাসআলাঃ শুধু রুপা থাকলে যাকাতের নেসাব হল সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা।
মাসআলাঃ বাকি সকল সুরতে যাকাতের নেসাব হল (শুধু টাকা-পয়সা থাকলে অথবা শুধু ব্যবসার মাল থাকলে অথবা চারটি সম্পদের প্রত্যেকটি থাকলে অথবা চারটির যে কোন তিনটি সম্পদ থাকলে অথবা চারটির যে কোন দুটি সম্পদ থাকলে) সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার যে কোন একটার মূল্যের সমপরিমাণ সম্পদ থাকা।
মাসআলাঃ ধরা যাক,বর্তমান বাজারে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য ৬৫,০০০ টাকা। এখন কারো নিকট ২ তোলা/ভরি সোনা রয়েছে যার বিক্রয়মূল্য ৮০,০০০ টাকা। আর উক্ত সোনার সাথে তার নিকট ১ টাকা রয়েছে। উক্ত ১ টাকা থাকার কারনে তার নেসাব সোনা থেকে রুপার দিকে পরিবর্তন হবে। কেননা তার মালিকানায় দুই প্রকার সম্পদ জমা হয়েছে । আর এই দুই প্রকার সম্পদের মুল্যমান যেহেতু সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য তথা ৬৫,০০০ টাকা থেকে বেশি তাই সে নেসাবের মালিক হবে। অর্থাৎ যখন এক ধরনের যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে অন্য আরেকটি যাকাতযোগ্য সম্পদ মিলানো হবে তখন ঐ মিলানো সম্পদটি পরিমানে যত কমই হোক না কেন (এক আনা -সোনা বা রুপা অথবা ১ টাকা বা তার সমপরিমান ব্যবসার মাল) তা ধর্তব্য হবে। এবং তার নেসাব রুপা দ্বারা গণ্য করা হবে। অর্থাৎ যাকাতযোগ্য সকল সম্পদ মিলে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য পরিমান হয় তবে সে নেসাবে মালিক গন্য হবে।
মাসআলাঃ যেহেতু রুপার নেসাবের মুল্যমান সোনার নেসাবের মূল্যমান থেকে কম তাই শুধুমাত্র সোনা থাকার সুরত ব্যতীত বাকি সকল সুরতে রুপা দ্বারা নেসাব নির্ধারণ হবে। অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমান সম্পদ থাকলে সে নেসাবের মালিক হবে।
যাকাত আদায়ের শর্তাবলীঃ
১.মুসলমান হতে হবে।
২.বালেগ হওয়া। কাজেই না বালেগ এর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩.বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া। পাগলের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৪.স্বাধীন হওয়া। গোলামের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৫.নেসাব পরিমান মাল থাকা।
৬.উক্ত মালের পূর্ণ মালিক হওয়া।
৭.উক্ত মাল তার মৌলিক প্রয়োজন সমূহের অতিরিক্ত হওয়া।
৮.উক্ত নেসাবের উপর পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া।
যাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়ঃ
মাসআলাঃগরীব-ফকীর লোককে যাকাত দিতে হবে। ধনী লোককে যাকাত দেওয়া যাবে না। ধনী দুই প্রকার। এক. যার যাকাতের নেসাব পরিমান মাল রয়ছে। এর আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। এমন লোক যাকাত আদায় করবে। দুই. যার উপর যাকাত ওয়াজিব হয়নি বটে তবে তার প্রয়োজন অতিরিক্ত এমন সম্পদ রয়েছে যার মুল্য যাকাতের নেসাবের মুল্য সমপরিমান। এমন লোকের উপর যাকাত ওয়াজিব নয় তবে ছদকায়ে ফেতর ও কুরবানী ওয়াজিব। উপরোক্ত দুই প্রকার ধনীকেই যাকাত দেওয়া জায়েয নেই।
মাসআলাঃ অমুসলিমকে যাকাত দিলে তা আদায় হবে না।
মাসআলাঃ ঋনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল ঐ ঋনী ব্যক্তির ধন আদায়ের পরে যেন নেসাব পরিমান সম্পদ না থাকে। যদি তার ঋণ আদায়ের পরেও তার নিকট নেসাব পরিমান সম্পদ থাকে তবে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই।
মাসআলাঃ যার নিকট নেসাব পরিমান সম্পদ আছে তাকে যাকাত দিলে আদায় হবে না।
মাসআলাঃ উসূল ও ফুরু কে যাকাত দেওয়া যায় না। উসুল বলতে বুঝায় যাদের মাধ্যমে সে দুনিয়াতে এসেছে। যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী পরদাদা-পরদাদী এভাবে যত উপরে উঠবে। ফুরু বলতে বুঝায় ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, পোত-পুতনী এভাবে যত নিচে নামবে। অর্থাৎ তার মাধ্যমে যারা দুনিয়াতে এসেছে।
মাসআলাঃ দুধ-মা,দুধ-সন্তান ও দুধ-পিতাকে যাকাত দেওয়া যায়।
মাসআলাঃ সৎ-মা, সৎ -পিতা ও সৎ-সন্তানকে যাকাত দেওয়া জায়েয আছে। তারা উসুল বা ফুরুর মধ্য গণ্য হয় না।
মাসআলাঃ মুসাফির ভিনদেশে যখন নিরুপায় হয়ে পড়ে, বাড়ি পর্যন্ত পৌছাতে অক্ষম তখন তাকে যাকাত দেওয়া যায় যদিও সে বাড়ীতে খুব ধনী হয়।
মাসআলাঃ যাকাতের অর্থ কোন গরীবকে মালিক বানিয়ে দেওয়া জরুরী। কাজেই যাকাতের অর্থ দিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে দিলে বা তার কোন আসবাব ক্রয় করে দিলে বা যে কোন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দিলে বা মাদ্রাসায় কিতাব ক্রয় করে ওয়াক্ফ করে দিলে বা মৃত বাক্তির ঋন আদায় করলে বা তার কাফনে খরচ করলে যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলাঃ মসজিদের ইমাম, মুআযযিন মাদ্রাসার শিক্ষক বা যে কোন চাকুরীজীবীকে যাকাতের অর্থ প্রদান করলে যাকাত আদায় হবে না। তবে তারা গরীব হলে ভিন্নভাবে তাদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে।
মাসআলাঃ যাকাতের অর্থ দ্বারা বাড়ি বানিয়ে গরীব লোককে মালিক না বানিয়ে বিনা ভাড়ায় ঐ বাড়িতে বসবাস করতে দেওয়ায় যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলাঃ জনকল্যাণমূলক কোন কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন- রাস্তা বা পুল নির্মাণ,কূপ স্থাপন ইত্যাদি।
মাসআলাঃ ভাই-বোন, চাচা-চাচী, মামা-মামী, খালা-খালু, ফুপা-ফুপী, শ্বশুর-শাশুড়ি, জামাই, ভাতিজা-ভাগিনা যদি গরীব হয় তবে তাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়।
মাসআলাঃ স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না।
মাসআলাঃ যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে লিপ্ত তাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়।
মাসআলাঃ নাবালেগ সন্তানের পিতা ধনী হলে ঐ নাবালেগকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। তবে বালেগ সন্তান যদি গরীব হয় তাহলে তার পিতা ধনী হলেও তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
মাসআলাঃ সাইয়্যেদ বংশীয়কে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।
মাসআলাঃ সরকার যদি যাকাতের অর্থ মাসআলা জেনে সঠিক খাতে ব্যয় করে তবে সরকারকে যাকাত দেওয়া যায়। অন্যথায় সরকারী ফান্ডে যাকাত দেওয়া যাবে না।
হাজাতে আছলিয়াঃ
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নেসাব দুই প্রকার। একটি যাকাত ফরজ হবার নেসাব অন্যটি কুরবানী ও ফেতরা ওয়াজিব হবার নেসাব। উভয় নেসাবের মালিক যাকাত গ্রহন করতে পারবে না। দ্বিতীয় নেসাব তথা কুরবানী ও ফেতরার নেসাব নির্ধারণ হয় প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ দ্বারা। তাই এই দ্বিতীয় নেসাব নির্ধারণ করতে হলে হাজাতে আছলিয়া তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও প্রয়োজন অতিরিক্ত জিনিস এর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারনা থাকা প্রয়োজন। যার দ্বারা কার উপরে কুরবানি, ফেতরা ও হজ্জ ফরজ সহজেই জানা যাবে। অথচ এ বাপ্যারে অধিকাংশ মানুষেরই স্পষ্ট ধারনা নেই। তাই এ ব্যাপারে কিঞ্চিত আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি।
মাসআলাঃ মানুষের জীপন যাপনে যা অত্যাবশ্যকীয় এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনে যা ব্যবহার আসে তাই তার হাজাতে আছলিয়া বা নিত্যপ্রয়োজন সম্পদ হিসেবে গন্য হবে। আর এটা ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
মাসআলাঃ বসতবাড়ি, বাড়ির আসবাবপত্র, পরিধানের কাপড়, ব্যবহারের গাড়ি ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত হাড়ি-পাতিল, ডেগ ও বাসনপত্র হাজাতে আছলিয়া তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের মধ্যে গন্য হয়।
মাসআলাঃ বড় বড় ডেগ, বড় বড় বিছানা ইত্যাদি যা দৈনন্দিন কাজে লাগে না বরং দু-এক বছরে কখনও অনুষ্ঠানে প্রয়োজন হয় তা হাজাতে আছলিয়ার মধ্যে গন্য হয় না।
মাসআলাঃ যে সকল আসবাবপত্র পুরো বছর প্রয়োজনে আসে না তা প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ। কাজেই মহিলারা আলমারিতে যে সকল কাপড় সাজিয়ে রাখে তা যদি মাঝে মধ্যে পরিধান করে অথবা অন্তত বছরে দু একবার পরিধান করে তবে তা হাজাতে আছলিয়ার মধ্যে গন্য হবে। অন্যথায় তা প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। অনুরুপভাবে কাপ-প্রিচ, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি যদি সারা বছরে কখনও ব্যবহারে না আসে তবে তা প্রয়োজনতিরিক্ত হিসেবে গন্য হবে।
মাসআলাঃ কারো ৫০ বিঘা জায়গা রয়েছে। এতে চাষ করে যে ফসল হয় তা তার সংসার খরচে ব্যয় হয়ে যায়। তাহলে পুরো ৫০ বিঘা জমি তার নিত্যপ্রয়োজনীয়। পক্ষান্তরে কারো ১০ বিঘা জায়গা রয়েছে। যার ৮ বিঘার ফসলে তার সংসার চলে যায়। তাহলে ২ বিঘা তার জন্য প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ হবে।
মাসআলাঃ কারো ১০টি বাড়ি রয়েছে। যার ভাড়া দ্বারা সে জীবিকা নির্বাহ করে। সংসার বড় হবার কারনে পুরো টাকা ব্যয় হয়ে যায়, কোন অংশ বাকি থাকে না। তবে এটা তার হাজাতে আছলিয়ার মধ্য গন্য হবে। পক্ষান্তরে কারো দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার একটির ভাড়া দ্বারা তার সংসার ভালভাবে চলে যায়। তবে অন্য ফ্ল্যাটটি তার জন্য প্রয়োজনতিরিক্ত হবে।
মাসআলাঃ পেশাজীবীদের পেশার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী হাজাতে আছলিয়ার মধ্য গন্য। যেমন- ট্রাক্টর, লাঙ্গল ইত্যাদি।
মাসআলাঃ টেলিভিশন প্রয়োজনতিরিক্ত জিনিষ।
মাসআলাঃ আলেম ও তালেবে এলেমের কিতাবাদি হাজাতে আছলিয়ার মধ্য গন্য।
মাসআলাঃ কাজের জন্য চাকর নওকর ও ব্যবহারের যানবাহন ( যা প্রয়োজনে একাধিক হতে পারে) হাজাতে আছলিয়ার মধ্য গন্য।
মোটকথা যা কোন ব্যক্তির জীবন যাপন ও জীবিকা নির্বাহে ব্যবহৃত তাই তার হাজাতে আছলিয়ার মধ্য গন্য। আর যা তার জীবিকা নির্বাহে কাজে আসে না বা যা ছাড়াও তার সংসার ভালভাবে চলে যায় বা যা তার দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারে আসে না এমনকি সারা বছরে কখনও প্রয়োজনে আসে না তাই তার প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ। উক্ত সম্পদ যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যমান সমতুল্য হয় তবে তার উপর ছদকায়ে ফিতর ও কুরবানী ওয়াজিব। আর উক্ত প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ যদি এ পরিমান হয় যে, তা দ্বারা পরিবারের খরচসহ হজ্জে যাওয়া যায় তবে তার উপর হজ্জও ফরজ হবে। কাজেই উপরে উল্লেখিত মাসআলাসমূহে যদি প্রয়োজনতিরিক্ত আসবাবপত্র বা পরিধানের কাপড় বা রান্নার কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী অথবা উক্ত দুই বিঘা জমি অথবা উক্ত একটি ফ্ল্যাট এর মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমান হয় তবে তার উপর কুরবানী ও ফেতরা ওয়াজিব হবে। আর যদি উল্লেখিত প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ্গুলো বিক্রি করে হজ্জে যাওয়া সম্ভব হয় তবে তার উপর হজ্জ ফরজ হবে। আর এমন ব্যক্তির জন্য যাকাত বা অন্য কোন ছদকায়ে ওয়াজিবা (মান্নত, কাফফারার মাল, ফেতরা, কুরবানীর চামড়ার পয়সা ইত্যাদি ) গ্রহন করা জায়েয নয়।
যাকাত হিসাব ও আদায়ের পদ্ধতিঃ
মাসআলাঃ সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ যাকাত আদায় করা ফরজ। অর্থাৎ শতকরা আড়াই টাকা। কাজেই কারো ৮০,০০০( আশি হাজার) টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকলে সে ২,০০০ ( দুই হাজার ) টাকা যাকাত দিবে।
মাসআলাঃ যাকাতের অর্থবছর চান্দ্র মাস হিসেবে নির্ধারণ হবে। ধরা যাক কেউ রজব মাসের ৫ তারিখে নেসাবের মালিক হল। তাহলে আগামী বছর রজবের ৪ তারিখে তার বছর পূর্ণ হবে। ঐ দিন তার নিকট যে সম্পদ থাকবে তার যাকাত আদায় করবে।
মাসআলাঃ যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত হল বছরের শুরু ও শেষে নেসাব পরিমান সম্পদ থাকতে হবে। উপরে উল্লেখিত তারিখ অনুযায়ী রজবের ৫ তারিখে তো তার নিকট নেসাব পরিমান সম্পদ থাকবেই। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য পরের বছর রজবের চার তারিখে তার নিকট কমপক্ষে নেসাব পরিমান সম্পদ থাকতে হবে। যদি না থাকে তবে তার উপরে যাকাত ফরজ হবে না। নতুন ভাবে যেদিন নেসাবের মালিক হবে সেদিন থেকে নতুন করে বছর শুরু হবে।
মাসআলাঃ যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য বছরের শুরু ও শেষে নেসাব পরিমান মাল থাকা যথেষ্ট। মাঝখানে যদি মাল কমে যায় এমনকি নেসাব থেকে কমে গেলেও যাকাত ফরজ থাকবে। তবে যদি মাঝখানে পুরো সম্পদ নষ্ট হয়ে যায়, তার কাছে কোন সম্পদ না থাকে তাহলে পূর্বের হিসাব বাতিল হবে। আবার যখন নেসাবের মালিক হবে নতুন করে হিসাব ধরা হবে।
মাসআলাঃ প্রতিটি মালের উপর বছর পুরা হওয়া জরুরী নয়। বরং যেদিন সে নেসাবের মালিক হবে ঐ দিন থেকে এক বছর পূর্ণ হওয়ার পরই তার নিকট থাকা সকল সম্পদের যাকাত দিতে হবে। যদি বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র দুদিন আগে তার নিকট দশ লক্ষ টাকা আসে তবে ঐ দশ লক্ষ টাকার যাকাত দিতে হবে। অথচ ঐ টাকা তার নিকট এক বছর থাকেনি। বরং মাত্র দুই দিন ছিল। অনুরুপভাবে নেসাবের বছর পূর্ণ হওয়ার দু দিন আগে যদি তার থেকে দশ লক্ষ টাকা খোয়া যায় তবে ঐ দশ লক্ষ টাকার যাকাত দিতে হবে না। মোটকথা বছরের মাঝে যা আসে ও চলে যায় তা ধর্তব্য হবে না। বরং বছরের শেষের সম্পদ হিসাব করা হবে।
মাসআলাঃ যাকাত হিসাব করে আদায় করা জরুরী। যে দিন বছর পূর্ণ হবে সেদিন তার যাকাতযোগ্য সকল সম্পদ হিসাব করবে। ব্যবসা থাকলে তার সকল স্টক মিলাবে। অতঃপর শতকরা আড়াই পার্সেন্ট হারে যাকাত আদায় করবে। ধারনা বা আন্দাজ করে যাকাত দিবে না।
মাসআলাঃ সোনা-রুপার যাকাত হিসাব করার ক্ষেত্রে বিক্রয়মূল্য ধর্তব্য হবে। চাই ক্রয়মূল্য কম বা বেশী হোক। যেমন সোনার ভরি ৬০,০০০ টাকা হলে বিক্রি করতে গেলে স্বর্ণকার সাধারণত ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার টাকা দেয়। কাজেই এই ৪৫ বা ৪৮ হাজার টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। ক্রয়মূল্যের নয়।
মাসআলাঃ ব্যবসার পন্যের যাকাত বাজারদর হিসেবে আদায় করতে হবে। চাই তার ক্রয়মূল্য বেশি বা কম হোক। ব্যবসার পন্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনটি সুরত হতে পারে। এক. খুচরা মুল্য দুই. পাইকারি মূল্য বা হোল সেল প্রাইস তিন. সমস্ত স্টক একত্রে একবারে বিক্রি করলে যত টাকা হয়। ব্যবসায়ীরা এই তৃতীয় সুরতটি এখতিয়ার করতে পারে। তবে দ্বিতীয় সুরত তথা হোল সেল প্রাইস গ্রহন করার মধ্যই সতর্কতা।
মাসআলাঃ সোনা-রুপা ও ব্যবসার পন্য এর যাকাত হিসাবের ক্ষেত্রে যেদিন বছর পূর্ণ হবে এবং যাকাত হিসাব করা হবে সেদিনের বাজার দর হিসাব করতে হবে। ঐ দিন উক্ত জিনিসগুলো বিক্রি করতে গেলে যত টাকা পাওয়া যাবে তার উপর যাকাত আসবে।
মাসআলাঃ যে জিনিসের যাকাত আদায় করা হবে তা যে স্থানে রয়েছে সেখানকার বাজারদর হিসেবে যাকাত আদায় করতে হবে। যাকাতদাতার স্থান ধর্তব্য নয়।
মাসআলাঃ যাকাত যেমন টাকা-পয়সা দ্বারা আদায় করা যায় তেমনিভাবে কোন পন্য দ্বারাও আদায় করা যায়। যেমন- পরিধেয় বস্ত্র, খাবার, কিতাবাদি ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল তা প্রাপককে মালিক বানিয়ে দিতে হবে। কাজেই ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ীক পন্য মূল্য নির্ধারণ করে সরাসরি যাকাত বাবদ দিতে পারবে। তবে যদি পন্যটি এমন হয় যে, গ্রহনকারীর তা দ্বারা কোন ফায়েদা হবে না সেক্ষেত্রে মূল্য দিয়ে দিবে।
মাসআলাঃ মানুষ তার দৈনন্দিন প্রয়োজনে যে ঋণ নিয়ে থাকে তা যাকাতের হিসাব থেকে বিয়োগ করতে হয়। বিয়োগ করার পর যদি নেসাব পরিমান সম্পদ না থাকে তবে যাকাত ফরজ হবে না।তবে প্রবৃদ্ধির জন্য যে ঋণ নিয়ে থাকে তা যাকাতের হিসাব থেকে বিয়োগ হবে না।আর বর্তমানে যে বড় বড় শিল্প ঋণ বা উন্নয়নমূলক ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে তার হুকুম পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
মাসআলাঃ যাকাতের হিসাবের ক্ষেত্রে চান্দ্রমাস অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। প্রথম যে দিন সে নেসাবের মালিক হবে তা লিখে রাখবে। যেমন কেউ রজবের ৫ তারিখে নেসাবের মালিক হলে পরের বছর রজবের ৪ তারিখে যাকাত আদায় করবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সে কোনদিন নেসাবের মালিক হয়েছে তার হিসাব রাখে না। বরং খেয়াল খুশী মত আদায় করতে থাকে। এভাবে যাকাত আদায় করা জায়েয নয়। বরং যে নেসাবের মালিক কবে হয়েছিল তা জানে না, সে এখন থেকে তার হিসাব করা সহজ হয় এমন একটি আরবী তারিখ নির্ধারণ করে নিবে। এরপর থেকে সে ঐ তারিখেই যাকাত হিসাব করবে। ইচ্ছা করলে রমযানেও সে তারিখটি নির্ধারণ করতে পারে। এমতবস্থায় সে এস্তেগফার করবে এবং সতর্কতামূলক কিছু বেশি আদায় করবে। আর নেসাবের মালিক হওয়ার দিনটি স্পষ্ট জানা থাকলে ঐ তারিখ পরিবর্তন করা জায়েয নেই।
মাসআলাঃ অনেকে ৭০ গুন সওয়াবের আশায় তার তারিখ জানা সত্ত্বেও রমযানে যাকাত আদায় করে। এবং বিনা কারনে যাকাতকে রমযান পর্যন্ত বিলম্বিত করে। অথচ বিনা কারনে এমনটি করা গুনাহের কাজ। তবে সে এমনটি করতে পারে, যেহেতু যাকাত অগ্রিম আদায় করা যায় তাই যখন সে নেসাবের মালিক হবে তখন বছর পূর্ণ হবার পূর্বে যে রমযান আসবে সেই রমযানে একটি অংশ আদায় করবে যাকাতের নিয়তে। পরবর্তীতে বছর পূর্ণ হওয়ার পর হিসাব করে দেখবে যদি বেশি দেয়া হয় তবে তা নফল দান হবে। আর কম হলে বাকিটুকু আদায় করবে। আর যদি রমযানে বছর পূর্ণ হয় তাহলে তো রমযানেই আদায় করবে।
মাসআলাঃ ব্যবসায়ীদের আদায়যোগ্য বকেয়া টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। অর্থাৎ বাকিতে যে সকল পন্য বিক্রি করে থাকে তার মূল্যের উপরও যাকাত আসবে। এক্ষেত্রে ঐ টাকা হস্তগত হওয়ার পর যাকাত আদায় এর সুযোগ রয়েছে। তখন বিগত বছরগুলোর যাকাত হিসাব করে আদায় করেবে। তবে হিসাব করে প্রতি বছর নিয়মমত যাকাত আদায় করাই উত্তম। কেননা পরিমান বেশি হলে একসাথে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর যদি ঐ টাকা পাবার কোন আশা না থাকে তবে যাকাত দিতে হবে না। তবে পেয়ে গেলে বিগত বছরগুলো সহ আদায় করে দিতে হবে।
মাসআলাঃ যে ঋন ফেরত পাওয়ার আশা নেই তার উপর যাকাত ফরজ নয়। তবে পেয়ে গেলে বিগত বছরের যাকাত হিসাব করে আদায় করে দিতে হবে।
মাসআলাঃস্ত্রীকে মালিক বানিয়ে সে অলংকার বা সম্পদ স্বামী বা পিতা দিয়ে থাকে তার মালিক উক্ত স্ত্রী বা মেয়ে। কাজেই সেই তার যাকাত আদায় করবে। স্বামী বা পিতা তার অনুমতিক্রমে সইচ্ছায় আদায় করলে সেটা ভিন্ন কথা।
মাসআলাঃ মহিলাকে তার স্বামী বা পিতা ব্যবহারের জন্য অলংকার দিলে তার মালিক স্বামী বা পিতাই থাকবেন। কাজেই যাকাত তাদের জিম্মায় থাকবে।
মাসআলাঃ নাবালেগ সন্তানের নামে যে সম্পদ সংরক্ষণ করে রাখা হয় বা নাবালেগ মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য তার নামে যে অলংকারদী বানিয়ে রাখা হয় বা তাদের নামে ব্যাংক একাউন্টে যে টাকা রাখা হয় বা তাদের নামে ব্যবসায় যে টাকা খাটানো হয় তার মালিক নাবালেগ সন্তানেরা। এগুলোর যাকাত পিতামাতার উপর আসবে না।
মাসআলাঃআর বালেগ সন্তানের নামে যে অলংকার বানানো হয় বা টাকা ব্যবসায় লাগানো হয় বা তাদের নামে যে সম্পদ সংরক্ষণ করে রাখা হয় তার মালিক পিতা/মাতা। তাদেরকে এগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার পূর্বে তারা মালিক হবে না।
মাসআলাঃ যাকাত আদায়ের জন্য নিয়ত জরুরি। নিয়ত ব্যতীত যাকাত আদায় হবে না। এই নিয়ত যাকাত দেওয়ার সময় করা যায়। আবার যাকাতের নিয়তে সম্পদ আলাদা করে রাখলেও নিয়তের জন্য যথেষ্ট। যদিও দেওয়ার সময় নিয়ত না থাকে।
মাসআলাঃকেউ ফকীরকে মাল দেওয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করেনি। এখন যদি ঐ মাল ফকিরের হাতে থাকা অবস্থায় নিয়ত করে তবে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আর যদি ফকীর খরচ করে ফেলে তবে যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলাঃ যাকাত যেমনিভাবে নিজে দেওয়া যায় তেমনিভাবে কাউকে উকীল বানিয়ে তার দ্বারা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে মুআক্কিলের(যাকাত দাতার)নিয়তই যথেষ্ট। উকিলের নিয়ত না থাকলেও সমস্যা নেই।
মাসআলাঃ উকীল যদি মুআক্কিলের (যাকাত দাতার) যাকাত বাবদ প্রদেয় টাকা না দিয়ে নিজের টাকা দেয় তবে যাকাত আদায়ের জন্য শর্ত হল উক্ত যাকাতের টাকা উকিলের নিকট মউজুদ থাকতে হবে। উকীল যদি উক্ত টাকা খরচ করে ফেলে বা নিজের টাকার সাথে মিশিয়ে ফেলে অতঃপর নিজের টাকা থেকে যাকাত আদায় করে তবে যাকাত আদায় হবে না। অনুরূপভাবে নিজের টাকা থেকে দেবার সময় উকীল নিয়ত না করলে যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলাঃ কেউ কাউকে না জানিয়ে তার যাকাত আদায় করলে যাকাত আদায় হবে না। অনুমতিসাপেক্ষে আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ একজন ফকীরকে কমপক্ষে এতটুকু যাকাত দেওয়া উত্তম যাতে সে অন্তত ঐ দিন কারো নিকট মুখাপেক্ষী না হয়। অবশ্য এর কম দিলেও আদায় হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ কাউকে এই পরিমান যাকাত দেওয়া মাকরূহ যার দ্বারা সে নেসাবের মালিক হয়ে যায় এবং যাকাত ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে দিলে আদায় হয়ে যায়।
মাসআলাঃ এক শহরের যাকাত অন্য শহরে পাঠান মাকরূহ তবে যদি অন্য শহরে তার গরীব আত্মীয় থাকে বা অন্য শহরের লোক বেশি অভাবগ্রস্ত হয় বা দ্বীনী কোন উপকারীতা থাকে তবে পাঠান জায়েয।
মাসআলাঃ যাকাতের অর্থ দেবার সময় যাকাতের কথা বলে দেওয়া জরুরী নয়। বরং না বলাই উত্তম। কারন এর দ্বারা অনেকে কষ্ট পেতে পারে। যাকাতের নিয়তে হাদিয়া, পুরষ্কার বা ব্খশিশ এর নামে দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে যদি এমন কোন গরীব মানুষকে যাকাতের নামে ঋন দেয় যে, সে উক্ত ঋন পরিশোধ করতে পারবে না তবে এর দ্বারাও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তার এ নিয়তও থাকতে হবে যে, সে কখনও ঋন পরিশোধ করলে তা গ্রহন করবে না।
মাসআলাঃ যাকাত অগ্রিম প্রদান করা যায়। অর্থাৎ নেসাবের উপর বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আদায় করা যায় তবে শর্ত হল নেসাবের মালিক হতে হবে। কেউ যদি নেসাবের মালিক হবার পূর্বেই যাকাতের নিয়েতে কিছু দেয় তবে পরবর্তীতে নেসাবের মালিক হলে এবং যাকাত ফরজ হলে উক্ত দান নফল হিসেবে গন্য হবে। যাকাত আদায় হবে না।
মাসআলাঃ কারো যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর সমস্ত সম্পদ ছদকাহ করে দিলে তার যাকাত মাফ হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ কারো যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর যদি সমস্ত মাল বা কিছু অংশ খোয়া যায় বা নষ্ট হয়ে হয় তবে তার পুরো বা আংশিক অংশের যাকাত মাফ হয়ে যাবে। তবে যদি সে ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করে তবে তার মাফ হবে না। যাকাত আদায় করতে হবে।
মাসআলাঃ যাকাতের উপযুক্ত মনে করে কাউকে যাকাত দেওয়ার পর জানা গেল সে মালদার বা সাইয়্যেদ বংশ অথবা রাতের অন্ধকারে যাকাত দেওয়ার পর জানতে পারল সে তার উসুল বা ফুরুর অন্তর্ভুক্ত অথবা যাকাতের উপযুক্ত নয় তবে তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। তবে মুসলমান মনে করে কোন কাফেরকে যাকাত দিলে আদায় হবে না। পুনরায় উপযুক্ত ব্যক্তিকে দিতে হবে।
মাসআলাঃ কেউ কারো নিকট টাকা পাবে। এখন যাকাতের নিয়তে উক্ত ঋন মাফ করে দিলে যাকাত আদায় হবে না বরং তাকে যাকাত দিয়ে তার থেকে পাওনা উসূল করে নিবে।
মাসআলাঃ দ্বীনী ইলম চর্চারত আলেম-তালেবে এলম যাকাতের উপযুক্ত হলে তাদেরকে দেওয়া সবচেয়ে উত্তম। এক্ষেত্রে দিগুন ছওয়াব পাওয়া যাবে। অতঃপর নিকট আত্মীয়কে দেওয়া উত্তম।
আধুনিক ও সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় এর যাকাতের শরঈ হুকমঃ
শেয়ার এর যাকাতঃ
যারা শেয়ার ক্রয় করেন তারা মুলত দুটি উদ্দেশ্যে শেয়ার ক্রয় করে থাকেন। এক. বার্ষিক ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) গ্রহনের উদ্দেশ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শেয়ার ক্রয় করেন। অর্থাৎ কোম্পানির AGM থেকে যে লভ্যাংশ ঘোষণা হবে তাই তাদের উদ্দ্যেশ্য। দুই. যারা শেয়ারকে অন্যান্য পণ্যের মত লাভের আশায় বেচা-কেনা করেন। তাদের উদ্দ্যেশ্য থাকে আশানুরূপ দর পেলেই তার বিক্রি করে দিবে। বাৎসরিক লভ্যাংশ এদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না। এরা মুলত Capital Gain করে থাকে।
উপরোক্ত দুই শ্রেণীর শেয়ার হোল্ডারদের যাকাতের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন। যারা ক্যাপিটাল গেইন করেন তথা শেয়ারকে অন্যান্য পন্যের মত বেচাকেনা করেন তাদের যাকাতের হুকুম হল, তারা শেয়ারের বর্তমান বাজার দর এর উপর যাকাত আদায় করবেন। ফেস ভ্যালুর উপর নয়। অর্থাৎ যে দিন তার যাকাতের অর্থবছর পূর্ণ হবে সেদিন ঐ শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু কত? তার উপর যাকাত আদায় করবে।
আর যারা বার্ষিক লভ্যাংশের উদ্দেশ্যে শেয়ার ক্রয় করে তাদের যাকাতের হুকুম হল তারা প্রথমে কোম্পানীর ব্যালেন্স শিট দেখে কোম্পানীর স্থায়ী ( Fixed Assets) সম্পদ ও যাকাতযোগ্য সম্পদের অনুপাত বের করবেন। কোম্পানির স্থায়ী সম্পদ হল বিল্ডিং, মেশিন, জমি, গাড়ি ইত্যাদি। অর্থাৎ যেগুলো বিক্রি করা হয় না। আর যাকাতযোগ্য সম্পদ হল নগদ টাকা, ব্যবসায়ীক সামগ্রী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কাঁচামাল ইত্যাদি। অতঃপর কোম্পানীর মোট সম্পদের ( Assets ) যত পার্সেন্ট যাকাতযোগ্য হয় সে তার শেয়ারের বাজার দরের ততপার্সেন্ট এর যাকাত আদায় করবে। ধরা যাক একটি কোম্পানীর একটি শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০০ টাকা। আজ তার বাজার দর ২০০ টাকা। এদিকে কোম্পানীর স্থায়ী সম্পদ মোট সম্পদের ২০পার্সেন্ট। আর নগদ টাকা, ব্যবসায়ীক পন্য, কাঁচামাল ইত্যদি তথা যাকাত যোগ্য সম্পদ ৮০ পার্সেন্ট। তাহলে যিনি ক্যাপিটাল গেইন এর উদ্দেশ্য শেয়ার ক্রয় করেছেন তিনি আজ যাকাত দিলে ২০০টাকার যাকাত দিবেন। আর যিনি লভ্যাংশের উদ্দেশে শেয়ার ক্রয় করেছেন তিনি আজ যাকাত দিবেন[২০০-(২০*২)] ১৬০ টাকার। আর যদি কোম্পানীর ব্যালেন্স শীট পাওয়া না যায় বা কোম্পানীর আর্থিক অবস্খা জানা না যায় তবে সতকর্তামুলক পূর্ন বাজার দরের যাকাত দিয়ে দিবে ।
বন্ডের যকাতঃ
বন্ড মূলত ঋন এর সার্টিফিকেট। বন্ড সহ যবতীয় অর্থনৈতিক সনদ এর যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। কেননা এগুলো নগদ অর্থ এর হুকুমে।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের যাকাতঃ
সরকারী বা বেসরকারী চাকুরিজীবীদের বেতন থেকে জি,পি বা সি,পি ফান্ডের জন্য বাধ্যতামুলক যে অংশ কর্তন করা হয় তা উত্তোলনের পূর্বে চাকুরিজীবীর মালিাকানায় আসে না। তাই ফান্ডে থাকাকালীন উক্ত টাকার উপর যাকাত আসবে না।এবং হস্তগত হওয়ার পরেও বিগত বছরের যাকাত দিতে হবে না। তবে হস্তগত হওয়ার পরে পূর্ব থেকে নেসাবের মালিক না থাকলে উক্ত টাকার উপর এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর যকাত ওয়াজিব হবে।আর পূর্ব থেকে নেসাবের মালিক থাকলে যাকাত হিসাবের সময় উক্ত ফান্ড থেকে প্রাপ্ত টাকারও যাকাত দিতে হবে, সেক্ষেত্রে উক্ত টাকার উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। এ হল বাধ্যতামূলক ফান্ডের হুকুম।
আর যে সব চাকুরিজীবীরা (সরকারী বা বেসরকারী) বাধ্যতামূলকের পাশাপাশি ঐচ্ছিকভাবে টাকা রাখেন বা পূরোটাই ঐচ্ছিকভাবে রাখেন বা সে নিজ উদ্যোগে ঐ ফান্ডের টাকা অন্য কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে স্থানান্তর করিয়ে নেন তাদের উক্ত ফান্ডের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসাবে গন্য হবে।কজেই সে নেসাবের মালিক হলে উক্ত টাকারও যাকাত আদায় করবে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋনের যাকাতঃ
প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ মূলত তার নিজের। কাজেই যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে এই ঋন বিয়োগ হবে না । সুতরাং প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋন নিলে সে অর্থেরও যাকাত আদায় করতে হবে।
কোম্পানীর রিজার্ভ ফান্ডের যাকাতঃ
প্রত্যেক কোম্পানী তাদের মুলধনের একটি নির্ধারিত পার্সেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকে রিজার্ভ ফান্ড হিসাবে সংরক্ষিত রাখে। এটাকার ও যাকাত আদায় করতে হবে। যে সকল শেয়ার হোল্ডার ডিভিডেন্ড এর উদ্দিশ্য শেয়ার ক্রয় করেন তারা কোম্পানীর যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসাবের সময় রিজার্ভ ফান্ডেরও হিসাব করবেন। এবং তার শেয়ারের আনুপাতিক হারে (অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদ সহ) উক্ত রিজার্ভ ফান্ডেরও যাকাত আদায় করবেন।
বীমা বা ইন্সুরেন্স এর যাকাতঃ
বীমা বা ইন্সুরেন্সের যে কোন স্কীমে প্রদেয় মুলটাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ উক্ত টাকা এককভাবে বা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলে যদি নেসাব পরিমান হয় তবে বছরান্তে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। এখানে শুধু যাকাতের হুকুম বলা হল। বীমা করার শরঈ হুকুম সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
ব্যাংক থেকে পাওয়া সূদের যাকাতঃ
ব্যাংক থেকে বা অন্য যে কোন ভাবে পাওয়া সূদের টাকার উপর যাকাত আসবে না। সূদী চুক্তিকে আবদ্ধ হওয়া ও সূদী টাকা গ্রহন করা উভয়টিই হারাম । উক্ত টাকা কোন ভাবে হস্তগত হয়ে গেলে মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে মালিককে ফিরিয়ে দিবে। অন্যথায় ছাওয়াবের নিয়ত ব্যাতীত পূরো টাকা ছদকাহ করেদিবে।
বায়নানামার টাকার যাকাতঃ
জমি,ফ্ল্যাট,বাড়ী ইত্যাদি ক্রয় করার পর বায়না হিসাবে যে আংশিক টাকা দেওয়া হয় তার যাকাত বিক্রেতা আদায় করবে।
ভাড়াবাবদ অগ্রিম প্রদেয় টাকার যাকাতঃ
দীর্ঘমেয়াদী ইজারা বা ভাড়ার ভিত্তিতে অগ্রিম যে টাকা দেওয়া হয় তার যাকাত টাকা গ্রহনকারী আদায় করবে।
সিকিউরিটি ও গ্যারান্টি মানির যাকাতঃ
বর্তমানে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য জামানত বা সিকিউরিটি বাবদ কিছু টাকা দিতে হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে প্রতিষ্ঠান তাকে উক্ত টাকা ফেরত দেয়। উক্ত টাকার যাকাত টাকা প্রদানকারী আদায় করবে। গ্রহনকারী আদায় করবে না।অনুরূপভাবে ব্যাংকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিকিউরিটি হিসাসে গ্যারান্টি মানি প্রদান করতে হয়। উক্ত টাকা একাউন্ট হোল্ডারের মালিকানাধীন থাকে। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সে উক্ত টাকা উত্তোলন করতে পারে। এটাকাও যাকাতযোগ্য। যাকাতের হিসাবে সময় অন্যান্য সম্পাদের সাথে এটাকারও হিসাব করে যাকাত আদায় করবে।
ব্যাংক একাউন্টে গচ্ছিত টাকার যাকাতঃ
ব্যাংকের ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল প্রকার একাউন্টের গচ্ছিত টাকা যাকাতযোগ্য।চাই কারেন্ট একাউন্ট হোক বা সেভিংস একাউন্ট হোক বা ফিক্সড ডিপোজিট হোক বা দীর্ঘমেয়াদী ডিপোজিট হোক বা স্যালারী একাউন্ট হোক, সর্বপ্রকার একাউন্টের যাকাত আদায় করতে হবে যদি সে নেসাবের মালিক হয়। কাজেই যেদিন তার যাকাতের অর্থ বছর পূরা হবে ঐদিন সে সকল প্রকার একাউন্ট এর ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট দেখে গচ্ছিত টাকা গুলোর যাকাত হিসাব করে আদায় করবে।
ইম্পোর্টকৃত পন্যের যাকাতঃ
ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য ইম্পোর্ট করে থাকে । এক্ষেত্রে যে সব পন্য তাদের মালিকানায় চলে এসেছে তার বাজার দরের উপর যাকাত আদায় করবে যদিও উক্ত পন্য রাস্তায় থাকার কারনে তার কবজায় না আসে। আর যদি পন্য তার মালিকানায় না আসে বরং টাকা ইনভেষ্ট করেছে কিন্তু এখনো পন্যের ক্রয়চুক্তি হয়নি তবে শুধু ইনভেষ্টকৃত টাকার যাকাত আদায় করবে।
উন্নয়নমুলক ঋন ও শিল্প ঋনঃ
যাকাতের হিসাব থেকে মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে বা হাজাতে আছলিয়ার জন্য যে ঋন নিয়ে থাকে তা বিয়োগ করতে হয়।কিন্তু র্বতমানে ঋনের ধরনই বদলে গেছে। বড় বড় শিল্পপতিরাই এখন বেশী ঋনী। বাহ্যিকভাবে দেখে মনে হয় তারাই যাকাতের অধিক উপযুক্ত। একদিক থেকে যেমন তাদের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া উদ্ধেশ্য হয় অন্যদিক থেকে সরকারের পক্ষ থেকে আরোপিত মোটা অংকের ট্যাক্স ফাকি দেওয়াও তাদের উদ্দেশ্য থাকে।এগুলোকে উন্নয়নমুলক ঋন(Development loan)বা শিল্প ঋন (Industrial loan) বলে।
এখন প্রশ্ন হল এই ঋন এর যাকাত দিতে হবে কিনা ? অথবা এই ঋন যাকাতের হিসাবের সময় বিয়োগ হবে কিনা ?
এর জবাব হল মানুষ উন্নয়নমুলক যে ঋন নিয়ে থাকে তা সে কোন খাতে ব্যয়(Invest) করেছে তা দেখতে হবে। সে উক্ত টাকার মধ্যে যে টাকা অযাকাতযোগ্য সম্পদে (যেমন-কোম্পানীর বিল্ডিং,মেশিনারি,গাড়ি,জমি ইত্যাদি স্থায়ী সম্পদে[Fixed assets])ব্যয় করেছে তা যাকাতের হিসাবে কোন প্রভাব ফেলবে না। র্অথাৎ উক্ত টাকা যাকাতের হিসাবের সময় যোগ বা বিয়োগ কোনটিই করবে না। আর উক্ত শিল্প ঋন থেকে সে যে পরিমান টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদে (যেমন ব্যবসার কাঁচামাল ইত্যাদি) ব্যয় করেছে সেই সম্পদের বাজারদরের উপর যাকাত আসবে। র্অথাৎ যে দিন সে যাকাত এর হিসাব করবে সে দিন তার যাকাতযোগ্য সমস্ত সম্পদের হিসাব করবে যদিও উক্ত যাকাতযোগ্য সম্পদ ঋন হয়ে থাকে বা ঋন এর বিনিময়ে এসে থাকে। তবে সে তার সমস্ত যাকাতযোগ্য সম্পদের বাজারদর থেকে ঋনের যে টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করেছে তা বিয়োগ করবে।
উদাহরনসরূপ কোন ব্যক্তির এক কোটি টাকার ব্যবসায়ীক সম্পদ রয়েছে। এর মধ্য থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার বিল্ডিং,মেশিনারি ইত্যাদি রয়েছে। বাকি পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ব্যবসার কাচামাল রয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে তার পঞ্চাশ লক্ষ টাকার যাকাতযোগ্য সম্পদ রয়েছে। এখন সে এক কোটি টাকা ব্যবসাকে আরো সম্প্রসারের উদ্দেশ্যে লোন নিল।এই এক কোটি টাকা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সে জমি ,বিল্ডিং ইত্যাদি স্থায়ী সম্পদে ব্যয় করল। বাকি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিয়ে সে ব্যবসার কাচামাল ক্রয় করল। ফলে তার বর্তমানে মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ এক কোটিতে দাড়াল। এখন ধরা যাক, উক্ত ব্যক্তির যাকাতের অর্থ-বছর রজবের ৫ তারীখে সম্পূর্ণ হয়। কাজেই সে রজবের ৫ তারিখে যাকাত হিসাব করবে। রজবের ৫ তারিখে দেখা গেল তার পূর্বের ঐ এক কোটি টাকার যাকাতযোগ্য সম্পদের বর্তমান বাজারদর দেড় কোটি টাকা।এখন এই দেড় কোটি টাকা থেকে ঋনের যে অংশ সে যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করেছে তা যাকাতের হিসাব থেকে বাদ যাবে । অর্থৎ দেড় কোটি টাকা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বাদ যাবে। কেননা সে ঋনের এক কোটি টাকা থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করেছিল। এখন অবশিষ্ট এক কোটি টাকার যাকাত আদায় করবে । আর যদি রজবের ৫ তারিখে তার র্পুবের এক কোটি টাকার যাকাতযোগ্য সম্পদের বাজারদর কমে গিয়ে আশি লক্ষে দাড়ায় তবে তার উপর ত্রিশ লক্ষ টাকার যাকাত ফরজ হবে । কেননা সে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করেছে। কাজেই তা বাদ যাবে।
মোটকথা উন্নয়নমূলক ঋনের যে অংশ যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করা হয় তা পূরো যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বিয়োগ হবে। আর যে অংশ স্থায়ী সম্পদে ব্যয় করা হয় তা যাকাত হিসাবে কোন প্রভাব ফেলবেনা। র্অথাৎ কেমন যেন সে উক্ত ঋন গ্রহনই করেনি।
এখন প্রশ্ন হল এধরনের শিল্প ঋন (Industrial loan) বা উন্নয়নমূলক ঋন(Development loan) সাধারনত র্দীঘমেয়াদী হয়ে থাকে। যা প্রতিবছর কিস্তিতে সহনীয় পরিমানে আদায় করা হয়। এখন এ ঋনের যে অংশ যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয় করা হয় তার পুরোটাই যাকাত এর হিসাব থেকে বাদ যাবে নাকি প্রতিবছর যতটুকু ঋন পরিশোধ করবে ততটুকু বাদ যাবে?
এর জবাব হল, প্রতিবছর কিস্তিতে যতটুকু ঋন সে পরিশোধ করবে কেবল ততটুকু ঋন পুরো যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বিয়োগ করবে । উদাহরনসরূপ আমাদের উল্লেখিত উদাহরনে যদি উক্ত ব্যক্তির প্রতিবছরে এক কোটি টাকার জন্য দশ লক্ষ টাকা ঋন পরিশোধ করতে হয় তবে যাকাতযোগ্য সম্পদে ব্যয়কৃত পঞ্চাশ লক্ষ টাকার বিপরীতে প্রতিবছর ঋন পরিশোধ করতে হবে পাঁচ লক্ষ টাকা। কেমন যেন সে এবছর পাঁচ লক্ষ টাকা ঋনী।পঞ্চাশ লক্ষ নয়। কেননা যাকাতের হিসাব থেকে ঐ ঋন বিয়োগ করতে হয় যা সে এবছর আদায় করবে। কাজেই উক্ত ব্যক্তি প্রথম ছুরতে (যখন এক কোটি টাকার পন্যের বাজার দর বেড়ে গিয়ে দেড় কোটি টাকা হয়ে ছিলে )পাঁচ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে এক কোটি পয়তাল্লিশ লক্ষ টাকার যাকাত আদায় করবে।আর দ্বিতীয় ছুরতে (যখন এক কোটি টাকার পন্যের বাজার দর কমে গিয়ে আশি লক্ষ টাকা হয়ে গিয়েছিল) পাঁচ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে পঁচাত্তর লক্ষ টাকার যাকাত আদায় করবে। ফিক্হী দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে মাসআলাটিকে এভাবেই বুঝে আসে। আর এর মধ্যেই অধিক সতর্কতা রয়েছে।
পশু বা প্রানীর যাকাতঃ
মাসআলাঃ যে কোন ধরনের পশু ব্যবসার নিয়তে ক্রয় করা হলে তার মূল্যের উপর যাকাত আসবে।অর্থাৎ যেদিন যাকাতের হিসাব করবে ঐদিন তার বাজার দরের উপর যকাত দিয়ে দিবে।
মাসআলাঃ যে সকল প্রানী হাল চাষের জন্য বা বোঝা বহনের জন্য বা গাড়ী টানার জন্য পোষা হয় তার উপর যাকাত আসবেনা।
মাসআলাঃ গরু,ছাগল,ভেড়া,দুম্বা,উট ও মহিষ যদি বংশ বৃদ্ধির জন্য বা এমনেতিই পালন করা হয় তবে এগুলো সায়েমা হলে যাকাত আসবে। সায়েমা এমন জন্তুকে বলে যার বেশীর ভাগ সময়ের খাদ্য বা বেশির ভাগ খাদ্য নিজেদের দিতে হয় না।বরং মাঠে ময়দানে বা চরন ভূমি থেকে ঘাস পাতা খেয়ে বেচে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে এমন গরু , ছাগল ইত্যদি পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের গরু ,ছাগলকে বেশীর ভাগ সময় বা পূরো সময় কেনা খাবার বা তোলা খাবার দিতে হয়। কাজেই গরু,ছাগল ইত্যদি পশুর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রযোজ্য শর্ত তথা সায়েমা হওয়া আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তাই এর বিস্তারিত বিবরন উল্লে¬খ করা প্রয়োজন মনে করছি না। এর পরেও কোন পাহড়ী অঞ্চলে যদি এমন পশু পওয়া যায় তবে বিজ্ঞ মুফতীদের শরনাপন্ন হওয়া যেতে পারে।
মাসআলাঃ গরু, ছাগল,ভেড়া ,দুম্বা,মহিষ ও উট এই ছয়টি পশু ব্যতীত অন্য কোন পশুতে ব্যবসার নিয়ত ব্যতীত যাকাত ফরজ হয়না।
ফসলের যাকাত বা উশরঃ
বাংলাদেশের জমি উশরী না খারাজী , বর্তমানে এব্যপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া অত্যন্ত জটিল বরং অসম্ভব। এ দেশকে উলামায়ে কেরাম একসময় দারুল হরব বলে ঘোষনা করেছিলেন। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের জমি উশরী বা খারাজী কোনটিই হতে পারে না।
তবে ফিকহী দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে বুঝে আসে উক্ত হুকুম ঐ সকল দারুল হরব সম্পর্কে, যা পূর্বে থেকে দারুল হরব ছিল। আর আমাদের দেশ পূর্বে দারুল হরব ছিল না। বরং আটশত বছর দারুল ইসলাম থাকার পর দারুল হরব হয়েছিল। কজেই উক্ত হুকুম আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না। আবার ইংরেজরা এদেশের ক্ষমতা দখলের পর যে সমস্ত জমি মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মালিকানা বাতিল করে হিন্দুদেরকে জমিদারী প্রদান করেছিল, ঐসকল জমিও উশরী নয়। তবে এধরনের জমি খুজেঁ বের করাও কঠিন। এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত হল যে সকল জমি ধারাবাহিক ভাবে মুসলমানদের মালিকানায় চলে আসছে বলে প্রমান পাওয়া যায় সেগুলোকে উশরী ধরে উশর আদায় করবে।
আর যে সকল জমির ক্ষেত্রে জানা যায় যে, উক্ত জমি বিধর্মীর হাত থেকে মুসলমানদের হাতে এসেছে তবে তা খারাজী হিসাবে গন্য হবে এবং তার খারাজ আদায় করবে। যা প্রতিবছর একবার বর্তাবে। যদি উল্লে¬খিত সূরত জানা না যায় বা সন্দেহ হয় তবে সতর্কতা হিসাবে উশর আদায় করবে।
মাসআলাঃ জমির সেচ বৃষ্টির পানিতে সম্পন্ন হলে দশ ভাগের এক ভাগ উশর আদায় করবে। আর নিজ খরচে সেচ দিলে ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ উশর আদায় করবে।
মাসআলাঃ সেচ ব্যতীত অন্যান্য খরচের দ্বারা উশরের পরিমানে কোন তারতম্য হবে না। অর্থাৎ বৃষ্টির পানিতে সেচ হলে অন্যান্য খরচ (যেমন সারের খরচ, কৃষক খরচ ইত্যাদি ) যত বেশীই হোক না কেন তা ধর্তব্য হবে না। বরং দশ ভাগের এক ভাগ উশর দিতে হবে।
মাসআলাঃ উশরের সম্পর্ক ফসল ফলার সথে। কাজেই জমিতে ফসল না হলে বা চাষ না করলে উশর দিতে হবে না।
মাসআলাঃ জমিতে ফসল হোক বা না হোক খারাজ সর্বাবস্থায় দিতে হবে।
মাসআলাঃ আমাদের দেশে সরকারের পক্ষ থেকে জমির যে খাজনা নেওয়া হয়, এর দ্বারা উশর আদায় হবে না। বরং ভিন্ন ভাবে আদায় করতে হবে। তবে সরকারী খাজনা দেওয়ার সময় দাতা যদি খারাজের নিয়ত করে তবে এর দ্বারা খারাজ আদায় হয়ে যাবে।
মাসআলাঃ যাকাত যাদেরকে দেওয়া যায় তাদেরকে উশর দেওয়া যায়।