(আমি কোন সাহিত্যিক বা বিশেষ কোন লেখক নই। আর আমি এমন কোন ব্যক্তিত্বও নই, যার লিখা পড়া উচিত বা পড়া যেতে পারে। তবে উদ্দেশ্য একটাই, কিছু ঠাণ্ডা দিলকে গরম করা। কিছু জমে যাওয়া অন্তরে ইশকের আগুন জ্বালানো। কিছু গন্তব্যহীন মানুষকে গন্তব্যমুখী করা। এ ধরণের লিখা জীবনে এই প্রথম। যদি এই লিখার দ্বারা মাত্র একজন ব্যক্তিও বাইতুল্লাহের মুসাফির হয় তবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। এই লিখাকে সার্থক মনে করব। তাই পাঠকদের কেউ লিখাটি পড়ে বাইতুল্লাহ যিয়ারতের নিয়ত করলে অধমকে মেইলের মাধ্যমে জানানোর অনুরোধ রইল। খুব খুশী হব এবং তার সফরের জন্য দুআ করব।)
এক.
২০০৯ সালে পবিত্র বাইতুল্লাহ শরীফের সফরে গিয়েছিলাম। হজ্জ্ব করার জন্য। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। সে বারতো বিশ্বাস করতে পারিনি আমার মত গুনাহগার বাইতুল্লাহ শরীফের হাজিরার ডাক পাবে। বিশেষ করে আমার এক প্রবীণ উস্তাদ যখন বিদায় নেওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন “বাবা আমাদের জন্য একটু দু’আ করো, যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও কবূল করেন। বুঝি না আল্লাহ তাআলা এই গুনাহগারদের কেন যে ডাক দেন না”।
একথা শুনে আমি তো পূরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলার অপার করূনা যে আমার উপর বর্ষিত হচ্ছিল তা সহজেই অনুমান করতে পারছিলাম। আর এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে, আসলেই من جد وجد অর্থাৎ যে কোন কিছুকে পাওয়ার জন্য সহীহ পদ্ধতিতে মেহনত করে আল্লাহ তালাআ তাকে তার রহমতে সেটা দিয়েই দেন। তখন আমার মন বাইতুল্লাহ এর যিয়ারতের জন্য এতটাই অস্থীর হয়ে গিয়েছিল, তা ভাষায় বুঝানোর মত নেই। বিশেষ করে একদিন পাহাড়পুরী হুজুরের বয়ান শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “আমার হজ্জ্বে যাওয়ার ভীষণ আকাঙ্ক্ষা হল। আমি পাসপোর্ট করে একটি মাটির ব্যাংকে এক আনা দুআনা করে জমাতে লাগলাম। ঐ বছরেই হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, মিঞা আব্দুল হাই, আমাকে এক ব্যক্তি দশটি হজ্জ্বের টাকা দিয়েছেন। ৯ জনের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আর একজনকে আমি খুঁজছি। দেখ, আমি কখনো বুখারী শরীফ আউয়াল পড়িয়েছি আবার কখনো ছানী। তবে কখনো পুরোটা একসাথে পড়াইনি। তাই আমার মনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা আমি রওজায়ে আতহারের পাশে বসে পুরো বুখারী শরীফ কাউকে পড়াব। আমার মনের মধ্যে তোমার নাম এসেছে। তুমি কি বল? তখন আমি বললাম হুজুর আমি সব দিক দিয়ে প্রস্তুত। এরপর হুজুর আমাকে নিয়ে গেলেন।”
উক্ত বয়ান শুনে আমার জযবা আকাশচুম্বী হয়ে গেল। আমি ভাবলাম আমার মালিকও তো তাহলে আমাকে আমার অপারগতা সত্ত্বেও নিয়ে যেতে পারেন। আমি তো ফকীর, কিন্তু তিনি তো ধনী। আমি তো অসহায়, কিন্তু তিনি তো সকলের সহায় ও ভরসা। আমার খাজানায় তো কিছুই নেই, কিন্তু তার খাজানায় তো কোন অভাব নেই। আমি পাক্কা নিয়ত করে ফেললাম। বাইতুল্লাহ যিয়ারতের ইশকের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। হঠাৎ করে আল্লাহ তাআলা আমার কলিজাকে ঠান্ডা করে উক্ত আগুন নিভিয়ে দিলেন। ঐ বছরেই আমার যাওয়া হল। বুঝলাম সাধারণ মানুষই যখন তার বাড়িতে কেউ যেতে আবেদন জানালে, বারবার জানালে সে না নিয়ে পারে না, তবে যিনি পরম করুনাময় ও অসীম দয়ালু, যিনি সকলকে লজ্জা নামক পবিত্র বস্তু দান করেছেন, তিনি তার বাড়িতে না নিয়ে কিভাবে পারেন?

দুই.
আজ দীর্ঘ ১০টি বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু সেই আগুন আর অন্তরে জ্বলেনি। সেই অস্থিরতা অন্তরে আসেনি। এবার হঠাৎ করেই আমার মালিক কীভাবে যেন অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। অন্তরের আগুন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সামানের দিক দিয়ে ছিলাম একেবারে শূণ্যের কোটায়। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এবার আমার মাশুকের দরবারে যাবই, ইংশাআল্লাহ। আমার অসম্ভব ধনী মালিককে বললাম, একটু সুযোগ দাও না! আমি তো তোমার বীরহের আগুনে জ্বলে-পুড়ে একেবারে কাবাব হয়ে যাচ্ছি। আর কত? একটু (ইহরামের কাপড় পরে) পাগলামির সুযোগ দাও না? তোমার ঘরে যাওয়ার একটা সুযোগ দাও না? একটু তোমার সাথে প্রেম নিবেদন করতাম। তোমার সাথে একটু ভালোবাসার গল্পের চেষ্টা করতাম, দাও না? একটু।
আহ! আমার মালিক যে কত প্রেমময়, কত ভালো, কত আপন, শেষ পর্যন্ত আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন। আর তা এভাবে, পেপারে একদিন দেখলাম উমরাহ প্যাকেজ মাত্র ৬২,০০০ টাকা। ভাবলাম, মানুষ তো কত প্ল্যান করে। কেউ ধার করে বাড়ি বানায়, কেউ গাড়ি কেনে, কেউ জায়গা কিনে, কেউ নেশা করে। ও আমার দয়াময় মালিক, আল্লাহ, আমি তোমার মহব্বতের নেশায় মত্ত হয়ে যদি তোমার ঘর যিয়ারতের প্ল্যান করি তবে দোষণীয় কোথায়? এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা স্পষ্ট বলে দিল ৪০ এর কম বয়সে হবে না। আমি হতাশ হয়ে গেলাম। চোখে পানি চলে এল। তাহলে কি পারব না যেতে? পরদিন আরেক এজেন্সি দেখলাম ৬৫০০০/- টাকার প্যাকেজ। যোগাযোগ করলাম। তারা সম্মত হলেন।

তিন.
আল্লাহ তাআলার খাজানার দিকে তাকালাম। ঐ হাদীসটা বারবার মনে পড়ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّ مُتَابَعَةً بَيْنَهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
অর্থঃ তোমরা পর্যায়ক্রমে হজ্জ্ব ও ওমরা করতে থাক। নিশ্চয়ই পর্যায়ক্রমের হজ্জ্ব ও ওমরা দারিদ্র্য ও গোনাহকে এমনভাবে দূর করে যেভাবে কামারের হাপর লোহার জংকে দূর করে।–মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১৬৭; জামে তিরমিজী, হাদীস নং ৮১০
মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরী হল, হজ্জ্ব ও ওমরায় কোনদিন অর্থের কমতি ঘটে না। বরং বাড়ে। আমার আল্লাহ তাআলাও অতি অল্প সময়ে সব ব্যবস্থা করে দিবেন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হল। আব্বা ও আম্মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিলাম। মাদ্রাসার মুহতামিম সাহেব থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম। সব ঠিকঠাক থাকলে ৭ নভেম্বর যাওয়ার কথা। এদিকে মাদ্রাসার মাহফিল ছিল ১,২,৩ নভেম্বর। মাহফিলের দ্বিতীয় দিন বাসায় এলাম। বিছানায় যেতে ১২ টা বেজে গেল। হঠাৎ রাত দুইটার দিকে ফোন এল। ভাবলাম কেউ ভুলে দিতে পারে। আবার বাজল। পরান আতকে উঠল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি বড় ভাইয়ার ফোন। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হল। এত রাতে …………। ধরে শুনতে পেলাম “আব্বাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাচ্ছি, দুআ করিস”। ফোন কেটে গেল। শরীরের শক্তি হারিয়ে গেল। বুক ভেঙ্গে নিয়ে আসল। রাতটা যে কিভাবে কাটালাম ……………? সকালে মুহতামিম সাহেবকে জানিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সত্যি বলতে জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা বা দুঃসংবাদ আমার জন্য এটাই ছিল। তাহলে কি একা হয়ে যাব? এতীম হয়ে যাব? আমার আব্বাজানকে, আম্মাজানকে যে কত ভালোবাসি তা তো বুঝানো সম্ভব নয়।

চার.
যাই হোক, অবস্থার পরিবর্তন হল। সামনে কি হবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পৌছানোর পর রাতে হাসপাতালে গেলাম। আব্বাকে বেশ হাস্যজ্জল দেখলাম। তিনি যে অসুস্থ বোঝা যাচ্ছিল না। পরদিন আব্বা আম্মা উভয়ে বললেন, বাবা একটা নেক নিয়ত করেছ পিছপা হয়ো না। চলে যাও। আমি বলছিলাম আব্বাকে এভাবে রেখে কিভাবে যাব?
যাই হোক, সর্বশেষ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। এজেন্সির পক্ষ থেকে জানানো হল ভিসা হয়ে গিয়েছে। আমি চাইলে তারা ০৬.১১.১৮ ইং তারিখে টিকিট করতে পারে। তারা পুর্বেই জানিয়ে দিয়েছিল সফর থার্ড ক্যারিয়ারে হবে। হয়তোবা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অথবা কুয়েত এয়ারলাইন্স। অনুরোধ করলাম যেন ইন্ডিয়ান এলারলাইন্স না হয়। ইন্ডিয়ার নাম শুনলেই পরান আতকে উঠে। বিনা কারণে পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলা, আমাদের আকাবিরে উলামাদের উল্লেখযোগ্য পরিমানে হয়রানী করা সহ কত কিই-না তারা পারে? সর্বশেষে জানতে পারলাম যাওয়া ইন্ডিয়ান জেট এয়ারলাইন্সে আর আসা দুবাই এর এয়ার এরাবিয়াতে। প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিয়ে হাসপাতালে আব্বার নিকট বিদায় নেওয়ার জন্য গেলাম। আব্বার ব্যাপারে ডাক্তাররা ধারণা দিয়েছিলেন তার হার্টে ব্লক থাকতে পারে। ২/৩ সপ্তাহ পরে এনজিওগ্রাম করলে বাস্তবতা বুঝা যাবে। আপাতত তারা রিলিজ দিয়ে দিবেন। পরদিন দুপুর ১.২০ মিনিটে ফ্লাইট। আমাদের বাসা ঢাকার শ্যামলিতে। সকাল বেলা প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বের হতে একটু দেরী হয়ে গেল। সকাল ১০ টা। এরপর আবার ৬০ ফিটে দীর্ঘ জ্যাম। একটু ঘাবড়ে গেলাম। আল্লাহ তাআলার দিকে মোতাওয়াজ্জেহ হলাম। দেখলাম এবার মাত্র ৪০ মিনিটে এয়ারপোর্টে পৌছে গেলাম। ভিতরে ঢুকার পূর্বে দুজন লোক এসে বলল ভাই আমাদের দুজন মুরব্বী ভিতরে আছেন। তারা কিছুই বুঝেন না। এরপর আবার মাঝে চার ঘন্টার ট্রানজিট। আপনি যদি একটু তাদের সাথে রাখতেন। আমি বললাম অবশ্যই। ভিতরে গিয়েই তাদের পেয়ে গেলাম। বললাম, সর্বদা আমাকে ফলো করবেন। তারা খুব খুশী হলেন। বোডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করলাম। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা পর ফ্লাইট।

পাঁচ.
সময়মত প্লেনে উঠলাম। খুবই আশ্চর্য লাগে যখন দেখি বিমান বালাদের প্রায় ৯০ শতাংশই মহিলা। এর জন্য বাহ্যিক বেশভুষার দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপরে পোশাকের অঙ্গভঙ্গিও একটি বড় বিষয়। আমার কাছে মাতৃজাতীর সম্ভ্রম ধুলিস্যাৎ করার অনেক বড় একটা হাতিয়ার মনে হয়।
প্লেনের সিটে দুই পাশে দুই মহিলা। ডান পাশে আমাদের কুমিল্লার একটি মেয়ে। বয়স ২৭/২৮ হবে। সম্ভবত তার স্বামী সৌদীর কোন জায়গায় থাকে। তার কাছেই যাচ্ছে। আর বাম পাশে ছিল আর্জেন্টিনার এক মহিলা। ভাবলাম বসা যখন হয়েছেই একটু দাওয়াত দেওয়া যাক। তাকে জিজ্ঞাস করলাম আপনি কোথা থেকে এসেছিলেন? মহিলা খুব বিনয়াবনত হয়ে একটু এগিয়ে বললেন আর্জেন্টিনা। ভদ্রমহিলা আমার মায়ের বয়সি হবেন। আমি বললাম ও ম্যারাডোনা, মেসীর আর্জেন্টিনা? তিনি মুসকি হাসি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। বললাম কত দিনের জন্য এসেছিলেন? বললেন মাত্র ২ দিন। ব্যবসায়িক কাজে এসেছিলেন। তিনি আমার পোশাকে খুব আশ্চর্য ছিলেন। আমাকে বললেন তুমি কি সর্বদাই এই পোশাকেই থাক? আমি বললাম, না। এটা হজ্জ ও ওমরাহ করতে গেলে পরতে হয়। সে বলল উমরা আবার কি? আমি বললাম সৌদি আরবের কাবা, বাইতুল্লাহ এর নাম শোনেননি? তিনি বললেন, না। হাইরে আজব কথা। তিনি নিজেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারী দাবী করেন অথচ কা’বাই চিনেন না। অথচ ঈসা আলাইহিস সালামের কিবলা ছিল এই কাবা। এই ঘরের মালিকেরই তিনি ইবাদাত করতেন। যাই হোক উমরার বাস্তবতা সম্পর্কে তাকে কিছুটা বুঝালাম। পরে আমি তাকে বললাম, দেখ আমাদের এক সত্ত্বার নিকটে সবাইকে যেতেই হবে। এই পৃথিবীতে কেউ থাকবে না। তাই সেখানকার ব্যাপারে একটু ভাবা উচিত। সে বলল, অবশ্যই, আমি এটা বিশ্বাস করি।
খাবার পরিবেশনের সময় হলে বিমানবালা আমার নিকট জানতে চাইলে ভেজির কথা বললাম। কেননা অমুসলিম কোন রাষ্ট্রের এয়ালাইন্সে মুরগি, গরু, খাসী ইত্যাদি খাওয়া নাজায়েয হবে এটাই স্বাভাবিক। অমুসলিমদের জবাই মুসলমানদের জন্য হালাল নয়। প্লেনেই সফরনামা লিখা শুরু করলাম। সফরনামার একটা বড় অংশ প্লেনেই লিখে ফেললাম। ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর প্লেন মুম্বাই অবতরণ করল। এখানে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় কাটাতে হবে। দীর্ঘ পথ চলার পরে হঠাৎ সেই দুই মুরব্বীর কথা মনে পড়ল। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম তারা প্রায় আধা কিলো দূরে। অপেক্ষা করে সাথে নিয়ে নিলাম। টিকেট কাউন্টারের কাজ সেরে চেকিং এ গেলাম। বাহ! কি যে ব্যবহার কাষ্টম পুলিশের। যেন আমরা কিছু অমানুষ তাদের দ্বারস্থ হয়েছি। তবে খুব ভালো লাগল একটু পরপর নামাযের জায়গা দেখে। ইস্তিঞ্জা উযূ সেরে নামাযের কামরায় গিয়ে নামায পড়ে নিলাম। আসরের নামায। মাগরিবের এখনো প্রায় ৪০ মিনিট বাকী। ভাবলাম একেবারে মাগরিব পড়ে বের হব। আসরের পরেই কিছু ভাই এগিয়ে এলেন বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে। তাদের সাথে কথা বললাম। একটু বয়ান করলাম দেশী ভাইদের। মাগরিবের সময় ঘনিয়ে এলে মসজিদ প্রায় ভরে গেল। আমিই ইমামতি করলাম। নামায শেষে সময় হলে প্লেনে উঠলাম। এবার খাবার পরিবেশনের সময় বিমানবালা বলল হালাল। অর্থ্যাৎ এগুলো মুসলমাদের কর্তৃক জবাইকৃত। যেহেতু জেদ্দার ফ্লাইট। সমাই মুসলমান তাই তারা এ ব্যবস্থাপনা রেখেছে। শুকরিয়া, ধন্যবাদ দাদা বাবুদের। মুসলমানদের দ্বীনী মুল্যবোধের এতটুকু মুল্যায়নের জন্য। এহরাম বেধে নিলাম। আমার পাশে ছিল ইন্ডিয়ান এক নব দম্পতি। তাদের আচার আচরণ ইহরামের কাপড় পরিধান করা সত্ত্বেও এমন ছিল যে, তারা ওমরার যাত্রি নাকি সিনেমার নায়ক-নায়িকা তা বুঝাই মুশকিল ছিল। বেশ ধৈর্য্যের সাথে তা সংবরণ করতে হচ্ছিল। যাই হোক জিদ্দায় ল্যান্ডিং হল। ২০০৯ সালে প্রায় ১১/১২ ঘন্টা লেগে গিয়েছিল জিদ্দা ইমিগ্রেশনে। তাই ভেবেছিলাম এবার কয়েক ঘন্টা তো লাগবেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল মাত্র ১ মিনিটে ইমিগ্রেশন হয়ে গেল। আরো আশ্চের্য্যরে বিষয় হল আমরা বের হওয়ার র্পূবেই আমাদের মাল হাজির। মাত্র ৫/১০ মিনিটে তারা বেল্টে মাল দিয়ে দিল? অথচ আমাদের দেশে তো কমপক্ষে ৩০/৪০ মিনিট সময় অপেক্ষা করতেই হয়। বের হয়ে এজেন্সির গাড়ি খুঁজে বের করলাম। দেখলাম বাসে ৭/৮ জন লোক। ভরার পরে ছাড়বে। আমি নীচে নেমে ইশার নামায পড়ে নিলাম। প্রায় সোয়া ঘন্টা পরে বাস মক্কার উদ্দেশ্যে ছাড়ল। আমার মক্কা। আমার প্রিয় নবীজীর মক্কা। মনে যে কত জল্পনা কল্পনা এই পবিত্র ভুখন্ডকে নিয়ে, কত কিছু যে অন্তরে উঁকি দেয় তার কোন ইয়াত্তা নেই। প্রায় সোয়া ঘন্টা পরে পৌছালাম মক্কায়। এয়ারপোর্টেই একটা সিম নিয়ে নিয়েছিলাম। মক্কায় নাছির ভাই নামে একজন রিসিভ করে হোটেলে তুলে দেওয়ার কথা। তার সাথে যোগাযোগ আগেই করে রেখেছিলাম। তিনি এলেন। তখন রাত প্রায় আড়াইটা। আমাদের হোটেল ছিল মিসফালাতে। বাঙ্গালিরা সাধারণত এদিকেই থাকেন। পায়রা চত্বরের একেবারেই নিকটে। বাইতুল্লাহ থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিনিটে হোটেলে পৌছা যায়।

ছয়.
অনেকেই খুব তাড়াহুড়া করেন। মক্কায় পৌছেই ওমরা করতে চলে যান। তখন শরীর থাকে খুব ক্লান্ত। আবেগ হয়ে যায় বেশ দুর্বল। তাই মাশুকের সাথে প্রেমালাপে খুব একটা সুবিধা করা যায় না। এজন্য ফ্রেশ হয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সতেজতার সাথেই আসা উচিত। তৃতীয় তলার একটি কক্ষে আমার সিট ছিল। কক্ষে আমি সহ ৫ জন। তারা সকলেই বিবাড়িয়ার, একজন সিলেটের ছিলেন। হোটেলে ঢুকতে প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গিয়েছিল। একটু বিশ্রাম নিয়ে ফজরে নামায পড়লাম। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল। আরেকটু বিশ্রাম নিলাম। এবার মনকে তৈরী করে প্রিয় মালিকের দরবারে হাজির হলাম। যেই ঘরের বীরহের যন্ত্রনা প্রায় ১০ বছর ধরে সহ্য করে আসছিলাম। সর্বশেষ পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু, লজ্জাশীল, প্রেমময় মাশুক একটি দাওয়াতপত্র পাঠিয়েই দিলেন। আসলে যারাই বীরহের যন্ত্রনায় অস্থীর হয়, তাদেরই দাওয়াতপত্র পবিত্র হিজায থেকে চলে আসে। যার সামান্যতম লজ্জা ও শারাফত আছে তার নিকট তার বাড়িতে কেউ আসতে চাইলে সে কি না এনে পারে? বিশেষ করে যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এমনকি প্রতিটি মুহূর্তে সে লজ্জাশীল প্রেমময় সত্ত্বার নিকট বারবার তার বাড়িতে আসতে চায়, একটু প্রেম নিবেদন করতে, একটু মনের ভাব আদান প্রদান করতে, একটু বীরহের ঝাজ কমাতে তবে ঐ লজ্জাশীল সত্ত্বাও তাকে তার বাড়িতে মেহমান হিসেবে না এনে, তার ডাকে সাড়া না দিয়ে কিভাবে পারেন? যাই হোক ধীরে ধীরে বাইতুল্লাহর দিকে অগ্রসর হলাম। নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন করে আবিষ্কার করছিলাম। সারা শরীরে কেমন যেন এক উত্তেজনা। বাইতুল্লাহ শরীফ প্রথম দেখতে যে দুআ করা হয় তা কবূল হয়। আমাদের আল্লাহ ওয়ালারা এক্ষেত্রে শিখিয়েছেন এই দুআ করার জন্য “হে আল্লাহ আমি সামনে যত নেক দুআ করব সবগুলো কবূর করুন”। ধীরে ধীরে বাইতুল্লাহ নজরে পড়ে গেল। আহ! আমি ধন্য হয়ে গেলাম। মনের সব আগুন কেমন যেন নিমিষেই নিভে গেল। আমার মাশুকের অপার করুণা আমার উপর মুষলধারে বর্ষিত হচ্ছিল। চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আমার মাশুকের ভালোবাসার প্রতিদান যে কিভাবে দিব তা বুঝতে পারছিলাম না। মন খুলে দুআ করতে থাকলাম। হাইরে কালো গিলাফের আসক্তি, যা আমাকে মত্ত করে রেখেছিল। আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্যই তো এই কালো গিলাফকে ঘিরে। …………..
প্রিয় পাঠক একটু কেঁদে নিলাম। প্রিয় আল্লাহ তাআলার অবিরাম করুণায় আপ্লুত হয়ে। এই কাগজেও যার (অর্থাৎ চোখের পানির) কিছুটা সংমিশ্রন রয়েছে।
যাই হোক দুআ শেষে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ শুরু করলাম। তেমন একটা ভিড় নেই। তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদের চুম্বনের সময় ব্যতীত অন্য সময় বাইতুল্লাহের দিকে তাকানো নিষেধ। ওয়াহ! ওয়াহ! কি আজীব পরীক্ষা। যে বাইতুল্লাহের টানে মানুষ এখানে আসে তার দিকেই তাকানো যাবে না। এরপরেও প্রিয় মাশুকের অভীমানি কত দাবী-দাওয়াই না মানতে হয়। প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নাত। অর্থাৎ বীরের ন্যায় হাঁটতে হয়। এ কি পাগলামী? হ্যাঁ, পাগলামিই তো দেখতে হবে। যন্ত্রনায় পাগল হয়েই তো এখানে এসেছিলাম। দুই হাত টান টান করে বুক ফুলিয়ে চলতে থাকলাম। এখানে বাহ্যিক অহংকার দেখানোই সুন্নাত। একে একে সাতটি চক্কর শেষ করলাম। রোদের বেশ তাপ। পিপাসা পেল। কি চমৎকার আমার মালিকের ইন্তেজাম? এখানে পানি পান করা সুন্নাত। শরীয়ত যে মানুষের তবীয়তের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাওয়াফ করতে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট লাগল। মাকামে ইব্রাহীম ও বাইতুল্লাহ উভয়টিকে সামনে নিয়ে দুই রাকাআত ওয়াজিবুত তাওয়াফ নামায আদায় করলাম। মন খুলে দুআ করলাম। পেট ভরে যমযমের পানি পান করে সাফার দিকে গেলাম। বাইতুল্লাহ এর দিকে ঘুরে দুআ করলাম। এখানকার প্রতিটি স্থানই দুআ কবূলের স্থান। যথা নিয়মে সাঈ শুরু করলাম। সামনেই নযরে এল সেই মিলাইনিল আখদারাঈন। অর্থাৎ দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তি স্থান। এখানে রয়েছে আরেক পাগলামী। একটা হালকা দৌড় দিতে হবে। একটু দ্রুত গতিতে চলতে হবে। এখানে দৌড়েছিলেন আমাদের আম্মাজান হযরত সারা (রাঃ)। শিশু হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পিপাসার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে খাবার-পানীয় এর খোঁজে সাফা-মারওয়ার মাঝে সাতবার আসা যাওয়া করেছিলেন। ঐ স্থানে একটু দৌড় দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার নিকট এই দৌড় খুব পছন্দ হয়েছিল। কিয়ামত পযর্ন্ত একে ইসলামের অন্যতম নিদর্শন বানিয়ে দিলেন। সমস্ত মহিলাদের পক্ষ থেকে তিনি একাই দৌড় দিয়েছিলেন। তাই পরবর্তীতে শুধু পুরুষরা দৌড়াবে। এখানে মহিলাদের দৌড়ের কোন বিধান নেই। আসলে হজ্জ্ব ও ওমরার অধিকাংশ বিধানই হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালামের স্মৃতি। পুরো হজ্জ্ব ও ওমরাতেই এমন অসংখ্য পাগলামীর প্রতিফলন ঘটাতে হয়। এ যেন এক পাগলের মিলন মেলা। না আছে কাপড়ের ভাব, না আছে কর্মে কোন তাৎপর্য। মাশুকের প্রেমে মত্ত হয়ে, পাগল হয়ে কেবল পাগলামীই করে যেতে হয়। মাশুক কখন তার প্রেমে একটু সাড়া দিবে এই আশায় তার ঘরের পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকে। ধীরে ধীরে মারওয়ায় গিয়ে পৌছালাম। এখানেও দুআ কবূলের স্থান। দুআ করলাম। পূনরায় সাঈ শুরু করলাম।
সাঈর মাঝে এক পাকিস্থানী সালাম দিল। আমাকে কিছু বলতে চায়। কোলে বাচ্চা। কাছে এসে বলল, ভাই আমি ৭ জন ভাবীকে নিয়ে এসেছি। সাথে অনেকগুলো বাচ্চা। আমাদের ১৩০০ রিয়াল কাল হারিয়ে গিয়েছে। পুলিশ বলেছে দু একদিনে পেয়ে যাবেন। ভাই, কিছু দেন। একটু বাচ্চাদের নিয়ে খেতাম। কত আশ্চর্যের কথা! বাদশাহের দরবারে এসে বাদশাহের নিকট না চেয়ে আরেক ফকীরের নিকট চাওয়া? ধিক্কার তোমার জন্য। ভাবলাম যদি ঘটনা সত্য হয় তবে এটা হওয়ারই কথা। এতগুলো ভাবীর দায়িত্ব তুমি একাই নিলে? অথচ মাহরাম ব্যতীত মহিলাদের জন্য হজ্জ্ব, ওমরায় আসা সম্পূর্ণ নাজায়েয। যাই হোক ৫ রিয়াল দিলাম। একটি একটি করে সাতটি সাঈ সম্পন্ন করলাম। দুই রাকাআত শোকরানা নামায আদায় করে হোটেলে চলে গেলাম। এখন শুধুমাত্র মাথা হলক করে হালাল হয়ে যাওয়া বাকী। ওমরার কাজ বেশ সংক্ষিপ্ত। ১। এহরাম বাঁধতে হয়। ২। তাওয়াফ করতে হয়। ৩। সাঈ করতে হয়। ৪। মাথা হলক করতে হয়। সব মিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক বা দুইয়ে হয়ে যায়। ওমরা শেষে ভালো করে গোসল করে নিলাম।

সাত.
এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে হারামে আদায় করাই প্রধান কাজ। এছাড়াও রয়েছে তাওয়াফ করা, ওমরাহ করা ইত্যাদি। রাতে লিটন মামা এলেন। তিনি আমার ছোট মামার শ্যালক। হোটেলে নিয়ে খাওয়ালেন ইশার পরে। সাথে কিছু ফলফ্রুট ও খাবার কিনে দিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই মহাপবিত্র মক্কা নগরীতেই থাকেন। আবদার জানালাম, মামা এবার তায়েফে নিয়ে যেতে হবে। মামা বললেন, ঠিক আছে। আগামীকাল। রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তিনটায় উঠে চলে গেলাম কাবা চত্বরে। তাকিয়ে থাকলাম কাবার দিকে। কত সুন্দর এই কাবা। চোখের নেশা কখনো মেটে না। নতুনত্ব ফুরায় না। ভালো লাগা বাড়তেই থাকে। মনের আগুন বাড়তেই থাকে। বীরহ যন্ত্রনা কমতে থাকে। অন্তরে বিভিন্ন আনাগোনা চলতে থাকে। চোখ, অন্তর বরং শরীরের প্রতিটি পশম এক প্রশান্তি অনুভব করতে থাকে।
সালাতুত তাসবীহ পড়লাম। প্রাণ খুলে দুআ করলাম। বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকাও অনেক বড় একটি এবাদত। হাদীস শরীফে আছে যারা বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হতে থাকে। ইশার নামাযের পর মামা এলেন। আমাকে মিসফালার কুবরী অর্থ্যাৎ ফ্লাইওভারের নিচে আসতে বললেন। সেখানে গেলাম। গাড়িতে ওঠার পর জানতে পারলাম প্রথমে আমাকে একটি বিশেষ খাবার খাওয়াতে এক জায়গায় নিয়ে যাবে। খাবারের নাম কড়ই। বাইতুল্লাহ থেকে প্রায় ১৪/১৫ কিঃমিঃ দূরে। পাকিস্তানিদের হোটেল। তোন্দল রুটি আর একটি কড়াইতে ব্রয়লার মুরগীর গোশত। আমি ভাবলাম হাইরে! এই পোলট্রির জন্য এত তোলপাড়। হালকা কাচা কাচা ভাব। মামা বললেন এটা নাকি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আমি হাসি সংবরণ করতে পরলাম না। এত কিছু বাদে এটাই ঐতিহ্যবাহী খাবার হল?
যাই হোক, খাবার শেষে চলতে লাগলাম। তুর্কীদের শাসনামলের পার্লামেন্ট, বিশ্বের অন্যতম দ্বীনী ইদারা উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি দেখলাম। এরপর মিনার দিকে গেলাম। কি আশ্চর্য। এই মিনাতেই তো পা ফেলানোর জায়গা থাকে না। হাজীদের তালবিয়ার ধ্বনীতে সর্বদা সরব থাকে। বিশ্বের সবচে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা মনে হয়। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ নিরব। দু একজন ছাড়া কোন মানুষ নেই। হাহাকার। যেন মিনার মাটি ও তাবুগুলো ঐ পাঁচ দিনের অপেক্ষায় কাঁদছে। প্রতিটি প্রহর গুনছে। কবে আসবে পাগলগুলো? কবে তাদের সাথে আমিও মাতোয়ারা হয়ে যাব?
মিনার পরে গেলাম মুযদালেফায়। সেই হজ্জ্বের স্মৃতিগুলো মনোপটে আসতে লাগল। শরীরের পশম শিউরে উঠতে লাগল। এই তো সেই মাশাআরুল হারাম। মুযদালেফার একমাত্র মসজিদ। এর সাথেই তো দশটি বছর আগে রাত কাটিয়েছিলাম। আবেগ নিয়ে। সবকিছু মনে উঁকি দিতে লাগল। এই মসজিদ গুলো বছরে একবারই খোলা হয়। মসজিদের সামনে একটু পায়তারা করলাম। এরপর চলে এলাম আরাফায়। হাজার হাজার নিম গাছ সম্বলিত আরাফা। আরবরা নাকি একে জিয়া গাছ বলে। কেননা জিয়াউর রহমান এটা আরাফায় প্রথম লাগিয়েছিলেন। পুরো ময়দান হাহাকার। মসজিদে নামিরায় গেলাম। এখানে হাজী সাহেবরা জোহর ও আসর যোহরের ওয়াক্তেই একসাথে আদায় করেন। এরপর গেলাম ঐতিহাসিক সেই জাবালে রহমত। এটাও আরাফায় অবস্থিত। এখানেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রওনা হলাম। মামা মক্কার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দেখাচ্ছিলেন। মসজিদে জিন দেখলাম। যেখানে একদল জিন এসে কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত শুনেছিলেন। এর পাশেই রয়েছে জান্নাতুল মা’লা কবরস্থান। যেখানে হযরত খাদীজা (রাঃ) সহ অসংখ্য সাহাবাদের কবর রয়েছে। জাবালে ছাওর দেখলাম। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবূ বকর (রাঃ) হিজরতের সময় আত্মগোপন করেছিলেন। প্রায় তিন কিলোমিটার উচু। হজ্জ্বের সফরে প্রায় অর্ধেক উঠেছিলাম। সফর সঙ্গিরা বৃদ্ধ হওয়ায় আর উঠা হয়নি। তবে সেই সফরে জাবালে নূরে উঠেছিলাম। যার উপরে রয়েছে গারে হেরা। নবুয়্যতের পুর্বে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধ্যান করতেন। সব যিয়ারত শেষে হোটেলে ফিরে এলাম।

আট.
ভোরে ভোরে বাইতুল্লাহতে চলে গেলাম। ফজরে নামায পড়ালেন বিখ্যাত ক্বারী শায়েখ শুরাইম। লক্ষ্য করলাম জাহরী নামায গুলো তিনিই সর্বদা পড়াচ্ছেন। ধারনা করছিলাম তিনি শুক্রবার ফজরের মাসনূন কিরাআত পড়বেন। ঠিক তাই। প্রথম রাকাআতে সূরা হামীম সিজদাহ আর দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ইনসান বা দাহর পড়লেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর দিনে এটা পড়তেন। কিন্তু মানুষের দ্বীনদারীর যে বর্তমানে কি করূন দশা তা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেক ভাইকে দেখলাম সিজদার আয়াতে সিজদাহ না করে রূকু করছেন। অনেকে তো রীতিমত লোকমাহ দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে তো বলেই ফেলে এটা কি তারাবীহ নাকি যে সিজহাদ হবে? নামাযের পরে হোটেলে ফিরে গেলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে হারামে এলাম। দেখলাম বেশ ভারী বর্ষণ হয়েছে। রাস্তা ঘাটে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। জুমআর খুতবা দিলেন শায়েখ শুরাইম। যবানের হেফাযত নিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন। নামায শেষে কামরায় চলে গেলাম। জুমুআর পরেই মামা আমাকে নিয়ে যাবেন একথা পূর্বেই বলে রেখেছিলেন। সেমতে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন। মামার বাসায় গেলাম। বাইতুল্লাহ থেকে ৪/৫ কিলোমিটার হবে। গতকাল পোলট্রি মুরগী খাইয়ে তৃপ্ত হতে পেরেছিলেন না মামা। তাই আজ বাসায় খাসীর গোস্ত রেঁধেছেন। কমপক্ষে ৫ কেজি তো হবেই। সব নাকি আমাকেই খেতে হবে। কি মুসীবত? তাই বেশ খানিকটা খেতে হল।
মাগরিবের পরে মামা বললেন, এখন তায়েফে নিয়ে যাবেন। চলে গেলাম তায়েফে। দূর থেকে মামা দেখালেন ঐ সূউচ্চ পাহাড়ে আমরা উঠব। ৮/১০ কিলোমিটার উচু পাহাড় তো হবেই। কমপক্ষে শ’খানেক ইউটার্নের ন্যায় তো আছেই। ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। উপরে ভীষণ শীত। ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। আল্লাহ তাআলার কি আজীব কুদরত। এই একটু আগে কি গরম। আবার এখন কি ঠান্ডা। হাইরে আল্লাহ! এ কি সৌন্দর্য্য। কত রকমের যে পাহাড়। আর রাস্তার বৈদ্যুতিক আলোয় পূরো তায়েফ এক অনন্য সৌন্দর্য্য পৌছে গিয়েছিল। হঠাৎ করে এমন কুয়াশা রাস্তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সামান্য সামনেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। খুব আস্তে আস্তে চলতে থাকলাম। তায়েফের শহরে ঢুকতেই কুয়াশা চলে গেল। ভাবতে লাগলাম প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই তায়েফে এসেছিলেন দাওয়াত দিতে। কত চড়াই উতরাই পার করে এসেছিলেন। কত কষ্ট হয়েছিল আমার হাবীবের। আর এসে কি আচরনই না পেয়েছিলেন তায়েফ বাসীর নিকট থেকে। এটা কারোই অজানা নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথায় দাওয়াত দিয়েছিলেন, তা মামা ও তার সঙ্গি জানেন না। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে আমরা দাড়ালাম। একটি হোটেলে তারা গেলেন। হোটেলের মালিক ক্যারেলার অধিবাসী। ভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের রান্নাবান্না। তারা রুটি ও ডাল খেলেন। খুব শীত ছিল। একটু ঘোরাঘুরী করে ফের মক্কার পথে চলে এলাম। আসার পথে পাহাড়ের উপরে একটি জায়গা রয়েছে যেখান থেকে নীচের পুরো রাস্তা দেখা যায়। কি অবাক দৃশ্য? চোখ তাক লেগে আসছিল। কিন্তু সেখানে এত ঠান্ডা বাতাস, দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। ফের রওনা হলাম। রাস্তায় দুটি চেক পোষ্ট। এখানকার চেক খুব কড়াকড়ি ভাবেই হয়। অবশ্য এখন সৌদী সরকার নতুন আইন করেছে ওমরার ভিসা দিয়ে সৌদীর যে কোন জায়গায় যাওয়া যায়। এরপরেও কিছুটা ভয় কাজ করছিল। কারণ আমার কাছে পাসপোর্ট ছিল না। এজেন্সিগুলো জেদ্দা থেকেই পাসপোর্ট তাদের নিকট নিয়ে নেয়। মামা বলছিলেন তারা একবার ধরলে ঝামেলায় না ফেলে ছাড়ে না। তাই মামা আমাকে পিছনে বসিয়েছিলেন। দেখলাম আমাদের লাইনের প্রত্যেকটি গাড়ি থামাচ্ছে। ভয় লাগছিল। আল্লাহ তাআলাকে ডাকতে থাকলাম। অবশেষে পার পেয়ে গেলাম। আমাদের গাড়ি থামালোও না। ধীরে ধীরে পবিত্র নগরীতে প্রবেশ করলাম। মামা হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

নয়.
বাইতুল্লাহ এর উত্তরে হালকা পশ্চিম দিকে ঘুরে হাতীম অবস্থিত। হাতীম বাইতুল্লাহ এরই অংশ। কুরাইশরা যখন বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেছিল তখন তাদের হালাল অর্থের অভাবে পুরো বাইতুল্লাহ এর ভবন নির্মান করতে পারেনি। ঐ দিকটাতে কিছু অংশ তারা খোলা রেখেছিল। একেই হাতীম বলে। অর্থ হল ভঙ্গিত অংশ। এখানে নামায পড়ার অর্থ হল বাইতুল্লাহ এর মধ্যেই নামায পড়া। একদিন ভিতরে ঢুকার ইচ্ছা করলাম। মাগরিবের পর। নামায শেষে এগিয়ে গেলাম। প্রচন্ড ভীড়। অনেক কষ্টে ঢুকলাম। ভাবলাম আউয়াবীনের নামাযটা আজ এখানেই সারি। নামায শুরু করলাম। ঠিকমত সিজদা দেওয়া যায় না। কখনো অন্য জনের পিঠের উপর সিজদা দিতে হয়। নামাযে দাড়াতেই দুপাশে দুজন মহিলা দাঁড়াল। কি সাংঘাতিক পরীক্ষা? মনে আছে হজ্জ্বের সময় একবার অনেক কষ্টে ঢুকেছিলাম। যখন বৈঠকে বসলাম কোথা থেকে এক মহিলা এসে ঠিক আমার কোলের পর এসে পড়ল। তার উঠার কোন অবস্থা বা সুযোগ নেই এত ভীড়। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আজীব পরীক্ষা। কেমন যেন আল্লাহ তাআলা দেখতে চান আল্লাহ তাআলার ঘরের মধ্যে আমার নযর আল্লাহ তাআলার দিকে নাকি আল্লাহ তাআলার বান্দীর দিকে। এবারও একই অবস্থা। দুপাশেই দুজন মহিলা। একেবারে শরীরের সাথে লেগে রয়েছে। যাই হোক পুরো আউয়াবীনের নামায হাতীমের ভিতরেই সারলাম। প্রাণ খুলে দুআ করলাম। চোখকে ভীষণভাবে অনুরোধ করতে থাকলাম, একটু পানি তোমার মালিককে হাদিয়া দাও না। এখনিতো সময়। একটু কাঁদো না। আমি, তুমি তাহলে ধন্য হয়ে যেতাম। আমার চোখ আমাকে ধন্য করল। বেশ খানিকটা পানি সে দৃষ্টিগোচরে আনল। কিছুক্ষণ পরেই সাফাই কর্মীরা অনুরোধ করলো অন্যকে সুযোগ দিতে। বের হয়ে গেলাম হাতীম থেকে। এবার ভাবলাম একটু মুলতাযামে দুআ করা যায় কিনা। একদিন বেশ খালি দেখে এগিয়ে গেলাম। হাইরে আমার আল্লাহ। এ কি অবস্থা? মানুষ জান দিয়ে দিচ্ছে। তবুও পিছপা হচ্ছে না। হাজরে আসওয়াদ থেকে বাইতুল্লাহ এর দরজা পর্যন্ত স্থানটুকুকে মুলতাযাম বলে। এটা দুআ কবূল হওয়ার একটি স্থান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে শরীর বুক চেহারা লাগিয়ে দুআ করেছিলেন। কিন্তু অনেকেই বরং বেশির ভাগ মানুষই ভুল করে। তারা দরজা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে। অথচ এটা মুলতাযাম না। চতুপার্শ থেকে মুহুমুহু ধাক্কা আসতে লাগল। দেখলাম এক লোক দীর্ঘক্ষণ খুব কাকুতি মিনতির সাথে দুআ করছে। পুলিশ ভাইকে অনুরোধ করলাম তাকে সরিয়ে আমাদের একটু সুযোগ করে দিতে। বলার সাথে সাথে পুলিশ প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। বলল, সে দুআ করছে। তাকে সুযোগ দাও। তোমার এত ইচ্ছা হলে এখানে আসো না কেন? ভাবলাম, হ্যাঁ তাইতো সে তার প্রাণ খুলেই দুআ করুক। এদিকে একদল মহিলা সামনে। আমাকে তারা অনুরোধ করছে সামনে না বেড়ে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এরপরে আর সেখানে দাড়াইনি। কারণ আমি বাস্তবতা ও শরীয়তকে উপেক্ষা করে জযবা ও আবেগকে প্রাধান্যদারকারী নই। আমির মনীব সব জায়গায় দুআ কবূলের জন্য অপেক্ষমান। চলে এলাম।
একটু চেষ্টা করেছিলাম হাজরে আসওয়াদকে সরাসরি চুমু দেওয়ার যায় কিনা। ২০০৯ সালে হজের সময় তিনবার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। একবারতো জামাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে গিয়েছিল। প্রিয় পাঠক আমি দূর্বল নই। শক্তিশালি, বেশ সুঠাম দেহ আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু আমি পাক্কা নিয়ত করে নিয়েছিলাম কাউকে ধাক্কা বা কষ্ট দিব না। তাইতো একবার খুব নিকটে গিয়েও হাত দিয়ে স্পর্শ করার পরেও চুম্বন করতে পারিনি। কোথেকে একটি স্রোত এসে ১০/১৫ হাত দূরে ছিটকে নিয়েছিল। তিন দিন চেষ্টা করেও পারিনি। কত মানুষের আর্তনাদ যে সেখানে শুনেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। কত মানুষকে যে মৃত্যু যন্ত্রনার ন্যায় ছটফট করতে দেখেছি তার ঠিক নেই। এর পরেও কেউ দমে না। কি এক নেশা তাদেরকে সামনে চালাতে থাকে। এবারও দেখলাম অনেক মানুষের আহাজারী। আর সামনে এগোলাম না। তবে আমি চাইলে ধাক্কাধাক্কি করে হয়তোবা চুম্বন করতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর সেই বিশেষ বানী-
قَدْ عَلِمْتُ أَنَّكَ حَجَرٌ وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبَّلَكَ مَا قَبَّلْتُكَ
অর্থঃ আমি জানি তুমি কেবল একটি পাথর। যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তোমাকে চুমু খেতে না দেখতাম তবে আমি তোমাকে চুমু খেতাম না।–মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২২৬
ফিরে এলাম। হলো না এবারও। এটা আমি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পেরেছি যে কিছু গোনাহে কবীরা ব্যতীত হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা প্রায় অসম্ভব। আর চুম্বন করা তো মুস্তাহাব। কিন্তু মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। তাছাড়া খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সরাসরি চুমু খাননি। বরং ইশারায় চুমু খেয়েছিলেন। না জানি সরাসরি চুমু খেলে মানুষ কি করত? মনে হয় জীবনটাই দিয়ে দিত।
এদিন ফোন দিলাম কিছু মহব্বতের মানুষকে। এদের কেউ কেউ ঢাকায় বাড়ি করেছে, কেউ নিজস্ব গাড়িতে চলে, কেউ গ্রামের বাড়িতে আলীশান বাড়ি করেছে, ঘরে টাইলস ও এসি লাগিয়েছে, কেউ জরুরতের নামে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। এমনিভাবে চাকচিক্যময়, নস্যাৎ, মশার পাখার চেয়েও তুচ্ছ এ পৃথিবীর অনেক সাধ ও ইচ্ছাই তারা পূরণ করেছে। কিন্তু পরম করুণাময়, প্রেমময়, অনন্ত ভালবাসার উপযুক্ত সত্ত্বার ঘরের যিয়ারতের ইচ্ছা তাদের অন্তরে কখনো জাগ্রতই হয়নি। আফসোস, তাদের জন্য। আমাদের প্রিয় হাবীব, যিনি তার জীবনটা আমাদের জন্য কুরবানী করে গিয়েছেন, তার সামনে সরাসরি সালাম দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার আগুনও তাদের অন্তরে জ্বলেনি। তাদেরকে একটু লজ্জা দিলাম। তাদের অন্তরে একটু আগুন ধরানোর চেষ্টা করলাম। তারা কথা দিল আগামী বছরই তারা আসার নিয়ত করেছে। তারা আমার নিকট দুআ চাইল। দুআ করলাম তাদের জন্য।

দশ.
বাইতুল্লাহতে প্রতিদিন এভাবে সময় যাপন করতামঃ যোহরের নামায হত সাড়ে বারোটায়। নামায শেষে কামরায় চলে যেতাম। ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে তিনটায় বাইতুল্লাহতে আসতাম। আসরের নামায হত সাড়ে তিনটায়। নামায শেষ করে চলে আসতাম মাতাফ তথা কাবা চত্বরে। আসর থেকে মাগরিব মাতাফেই (বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গনে) বসে থাকতাম। তাকিয়ে থাকতাম কাবার দিকে। কখনো তৃপ্ত হতাম না। কি যে এক ভালো লাগা তা কিভাবে বুঝাই? বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম মাগরিব পর্যন্ত। চোখ ও অন্তর কোনটাই তৃপ্ত হত না। বরং তাদের নেশা ও উন্মাদনা বাড়তেই থাকতো । আসলে কালো রং আমার খুব একটা পছন্দ নয়। কিন্তু (বাইতুল্লাহ এর গিলাফের) এ কালো যে কোন কালো তা বুঝতে পারতাম না। এর চেয়ে সুন্দর রং তো কখনো দেখিনি। এর মিষ্টতা, চাকচিক্য, সৌন্দর্য তো কখনো অনুভব করিনি। না আছে এর ভালো লাগার কোন শেষ, না আছে চোখ ও অন্তরের ক্ষুধা ও পিপাসার কোন সামান্যতম পরিতৃপ্ততা। অন্তর আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে দুলতে থাকে, এমনকি শরীরের প্রত্যেকটি পশমও তার মাস্তি অনুভব করে। চোখের আপোষহীন, নজরকাড়া দৃষ্টি ধীরে ধীরে প্রখর হতে থাকে। কিন্তু কেন যেন শেষ স্তরে কখনো পৌছা যায় না। পিয় পাঠক আমার আর কোন ভাষা নেই এই কালো গিলাফ সম্বলিত ঘরের বর্ণনা দেওয়ার।
প্রতিদিনই প্রায় পৌনে চারটা থেকে পৌনে ছয়টা পর্যন্ত দুই ঘন্টা সময় বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই সময়ে কয়েকদিন এই সফরনামাও লিখেছি। মাগরিবের পরে চেষ্টা করতাম আওয়াবীনের নামায আদায় করতে। আওয়াবীনের দুটি রেওয়ায়েত রয়েছে। ৬ রাকাআত ও বিশ রাকাআত। সাধারণত বিশ রাকাআতের উপর আমল করার চেষ্টা করতাম। এরপর বাইতুল্লাহ এর তাওয়াফ করতাম। তাওয়াফে ৩০/৩৫ মিনিট সময় লাগত। তাওয়াফ শেষে ইশার নামায কাছিয়ে আসত। ইশার নামায আদায় করে কখনো আবার বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম কখনো চলে আসতাম। খাওয়া দাওয়া করে কামরায় সাথীদের সাথে কিছু কথা-বার্তা হত। কারগুজারী শুনতাম আমলের। এরপর ঘুমিয়ে যেতাম। তিনটা সাড়ে তিনটার মধ্যে উঠে পড়তাম। জরুরত শেষে দ্রুত চলে যেতাম কাবা চত্বরে। কখনো বাইতুল্লাহ দেখতাম, কখনো সালাতুত তাসবীহ আদায় করতাম, কখনো একটু কাকুতি মিনতির সাথে চোখের পানি ঝরানোর চেষ্টা করতাম। কখনোবা নফল নামায আদায় করতাম। এরপর ফজরের নামায আদায় করতাম। যেদিন ওমরা করতাম নামায শেষেই চলে যেতাম মসজিদে তানঈন বা আয়েশায়। মক্কাবাসীদের জন্য কয়েকটি মীকাত রয়েছে ওমরার জন্য। সেগুলোর মধ্যে এটাই সবচে নিকটে। সাড়ে সাত কিলোমিটার দুরুত্ত মসজিদে হারাম থেকে। সূর্য উঠার ১৫/২০ মিনিট পূর্বেই পৌছে যেতাম মসজিদে আয়েশায়। মসজিদে হারামের চত্বরের পাশ থেকে লাল রঙ্গের বাস ছেড়ে যায় মসজিদে আয়েশার দিকে। ২৪ ঘন্টা চলে। ভাড়া নেয় ৩ রিয়াল করে। মসজিদে পৌছে এহরাম বাধতাম। অত্যন্ত চমৎকার মসজিদ। অতঃপর বাইতুল্লাহতে এসে ওমরা সম্পন্ন করতাম। হালাল হতে প্রায় ১০টা বেজে যেত। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার মসজিদে হারামে চলে যেতাম। আর যেদিন ওমরাহ করতাম না সেদিন মোটামুটি সকাল ১০টায় মসজিদে হারামে চলে যেতাম।
এই সময় থেকে নিয়ে সাধারণত যোহরের আযান পর্যন্ত এই সফরনামা লিখেছি। প্রিয় পাঠক এই সফরনামার খুব সামান্য একটি অংশ ব্যতীত পুরোটাই মসজিদে হারামে পবিত্র কাবাকে সামনে নিয়ে লিখেছি। বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকাতাম আর লিখতাম। সকাল ১০টার পর থেকে নিয়ে যোহর পর্যন্ত এবং আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত মাতাফে পবিত্র কাবার সামনে বসেই লিখেছি। অনুরূপভাবে সফরের মদীনার অংশ মসজিদে নববীতে রওজায়ে আতহারের পাশে বসেই লিখেছি।

এগার.
মাসজিদুল হারামের সার্বিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত চমৎকার। একেবারে দিশেহারা করে দেওয়ার মত। লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বদা অবস্থান করা সত্বেও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। নেই কোন ত্রুটি, নেই কোন অপরিপূর্ণতা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন জুড়ি নেই। কোথাও কোন বালুকনা পড়লেও সাথে সাথে তা পরিষ্কার করে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মসজিদুল হারামের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম অংশেরও পরিচ্ছন্নের জন্য রয়েছে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। সাফা, মারওয়া, মাকামে ইব্রাহীম ইত্যাদি বিশেষ স্থাপনা গুলোর পরিচ্ছন্নতা তো হতবাক করে দেয়। একদিন তাওয়াফের সময় দেখলাম মাকামে ইব্রাহীমের চুড়ার ১ গজের ন্যায় অংশ প্রায় ১৫/২০ মিনিট করে ডলাডলি করছে। আর হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানী তো কথাই নেই। এছাড়াও মসজিদের দেয়াল, পিলার, মাতাফ প্রত্যেকটি স্থানই সুন্দর করে মোছা হচ্ছে। যেখানে নাগাল পাওয়া যায় না সেখানে পোর্টেব্যল লিফটের সাহায্যে পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম মসজিদে হারামের খাদেমের সংখ্যা কত? তিনিও একজন খাদেম। জবাব দিলেন ৭ হাজার। ৮ ঘন্টা করে তিন শিফটে কাজ করে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বাহ, বাহ, সাবাশ হে পবিত্র হারামাইন শরীফাইনের খাদেম, সৌদি বাদশাহ, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মুসলিম জাহানের দুই মধ্যমনিকে তুমি ভালোই খেদমত করে চলেছ।
১৫/২০ গজ পরপর রয়েছে জমজম পানি পানের ব্যবস্থা। নরমাল ও ঠান্ডা পানি উভয়টি রয়েছে। কখনো কোন ড্রামের পানি শেষ হতে দেখিনি। সাথেই রাখা রয়েছে ওয়ান টাইম গ্লাস। আমার মনে হয় প্রতি সেকেন্ডে হাজার খানেক গ্লাস ব্যবহৃত হয়। খাদেমদের স্তরও রয়েছে কয়েকটি। কেউ পানি আনা নেওয়া করে। আবার কেউ ঠিকমত আনা-নেওয়া হচ্ছে কিনা দেখাশুনা করে। প্রতি ড্রামের পাশেই সর্বদা ব্রাশ নিয়ে একজন দন্ডায়মান। একফোটা পানি পড়লেই সাথে সাথে তা মুছে ফেলা হচ্ছে।
মাতাফের মত স্থান যেখানে সর্বদা কয়েক হাজার মানুষ অবস্থান করে, সেখানেও বিশেষ পদ্ধতিতে একটি বেল্টের সাহায্যে বলয় তৈরী করে পুরোটা মুছা হচ্ছে। মোছার জন্য অসংখ্য ছোট ছোট গাড়ি রয়েছে। রয়েছে অত্যাধুনিক বিভিন্ন মেশিন।
পুলিশ সর্বদা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ বিশেষ বিভিন্ন স্থাপনায় পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। রাস্তায় যেন মানুষ না বসে, বিদাআতী কোন কর্মকান্ডে যেন মানুষ লিপ্ত না হয়, ভিতরে ভারি সামানপত্র নিয়ে কেউ যেন যেতে না পারে, অযথা মানুষ যেন ভিড় না করে ইত্যাদি বিষয়ে পুলিশ খুবই সক্রিয়। এক্ষেত্রে তাদের ধৈর্য্যের কোন জুড়ি নেই। হয়রান হয়ে যাই, যখন দেখি একজন পুলিশ টানা দুই ঘন্টা সময় রাস্তা থেকে একের পর একজনকে উঠিয়ে দিচ্ছে। কত হাজার মানুষকে যে উঠিয়ে দিচ্ছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। একদলকে উঠিয়ে দিতে না দিতেই আরেকদল এসে বসে। পুলিশ অনর্গল বলে যাচ্ছে ইয়াল্লা তরীক, ইয়াল্লা হাজ তরীক, তরীক। ভাই ছাব রাস্তা, আম্মাজি রাস্তা চলো, উঠো। আশ্চর্যের বিষয় হল মক্কা মদীনার সকল স্থানে উর্দূ যেন দ্বিতীয় ভাষা। প্রত্যেকটি দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, মসজিদে হারামে, মসজিদে নববীতে এবং যিয়ারতের প্রত্যেকটি স্থানে সকল সৌদিরাই উর্দূ ভাষা ব্যবহার করে। আসলে উপমহাদেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বাদ দিলে খুব কম হাজী বা উমরাকারীই বাকী থাকবে। হাজীদের অনেক বড় একটা অংশ এই তিন দেশ থেকেই এসে থাকে। যাই হোক, পুলিশ খুব ধৈর্য্যরে সাথেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে।
মসজিদে হারামে বেশ কিছু তালীমের হালকা রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশের মত। সকাল সাতটা থেকে পড়াশোনা শুরু হয়। প্রায় বারোটা পর্যন্ত চলে। আন্ডারগ্রাউন্ড ও ১ম তলার বিভিন্ন স্থানে তা চলতে থাকে। প্রতিটি হালকাতে ৪০/৫০ জন করে তালেবে ইলম রয়েছে। সর্বদা একজন শিক্ষক তালীম দেন। আর একজন মুরাকিব রয়েছেন প্রতিটি হালকার জন্য। যিনি কে অনুপস্থিত আছে, ছাত্ররা ঠিকভাবে পড়াশোনা করছে কিনা ইত্যাদি বিষয়াবলি তদারকী করেন। প্রয়োজনে শাস্তিও দেন। একদিন দেখলাম একজন শায়েখ ইলমে নাহুর তালীম দিচ্ছেন। সবক শেষে তার সাথে একটু কথা বলার অনুমতি চাইলাম। বয়স ৩০/৩২ হবে। নাম আহমাদ বাইস। তার থেকে জানতে পারলাম মোট দশ বছরের কোর্স। উলূমে হাদীস ব্যতীত সবকিছু এখানে পর্যায়ক্রমে তালীম দেওয়া হয়। বাংলাদেশী অনেক ছাত্র রয়েছে। আমি বাংলাদেশী জানার সাথে সাথে একজন ছাত্রকে ডাক দিলেন যার বাংলাদেশে বাড়ি, চিটাগাং এ। এখানে পড়াশোনার জন্য ছাত্রদেরকে মাসিক বেতন দিতে হয়। সাড়ে চারশ রিয়েল। প্রায় সাড়ে দশ হাজার টাকা। জানতে পারলাম একজন উস্তাদের বেতন প্রায় এক লক্ষ পনের হাজার টাকা।

বার.
আমার প্যাকেজ ছিল ১৪ দিনের। ২ দিনের সফর বাদ দিলে মাঝখানে ১২ দিন। মক্কায় ৮দিন আর মদীনায় ৪ দিন। ধীরে ধীরে মক্কার দিন গুলো ফুরিয়ে এল। বাইতুল্লাহ ছেড়ে যাওয়ার পালা চলে এল। মন ভারাক্রান্ত হতে শুরু করল। প্রিয় মনীবের নিকট একটি আবদার অন্তরে ঝড় তুলছে “আমাকে যেন বাইতুল্লাহ এর লম্বা বিরতির বীরহের যন্ত্রনা সহ্য করতে না হয়”। আমাকে যেন প্রতি বছরই হাজিরার তৌফীক দেওয়া হয়। এজেন্সির লোক নাসির ভাই জানিয়ে দিয়েছিলেন আগামীকাল ভোর ছয়টায় মদীনার বাস। ভোর তিনটার দিকে উঠে সাড়ে তিনটা নাগাদ বাইতুল্লাহ হতে গিয়ে হাজির হলাম। আজ প্রিয় মাশুককে বিদায় জানানোর দিন। প্রিয় মাহবূব ও মাশুক থেকে বিদায় নেওয়া যে কি যন্ত্রনা তা সকল আশেকই বুঝে থাকে। এ বীরহের যন্ত্রনার থেকে অনেকের নিকটই মৃত্যু শ্রেয়। তাইতো পত্রিকার খবরে প্রায়ই দেখা যায়, একজন অন্যজনকে হারানোর বেদনা, যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। প্রিয় পাঠক এটা তো ছিল সম্পূর্ণ নাপাক ইশক্ব। তাই পাক, পবিত্র ভালবাসার (যেটা আল্লাহর সাথে বান্দার হয়ে থাকে) বীরহের যন্ত্রনা কতটা কঠিন তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন। আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, এ সময়ই (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সময়) বিদায়ী তাওয়াফ করব। বাইতুল্লাহ ছেড়ে আসার পূর্বে এ তাওয়াক করা ওয়াজিব। অত্যান্ত ভারাক্রান্ত মনে তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম। কথা অনেক পূর্বেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আগে থেকেই নিয়ত করেছিলাম শেষ দিন রাতে বিশেষভাবে অনেক দুআ করব। কিন্তু হায়, এ কি হল। মুখে কোন দুআই যে আসছে না। অনেক চেষ্টা করলাম একটু দুআ করার, কিন্তু পারিনি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে একটু চোখের পানি ঝরাতে চেয়েছিলাম। সম্ভবত তাও পারিনি। শুধুমাত্র ফ্যাল ফ্যাল করে বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অনেক কাকুতি মিনতির সাথে আমার মহান আল্লাহকে একটু বলার চেষ্টা করলাম, ও আমার প্রিয় মাশুক আমাকে খুব দ্রুত তোমার দরবারে হাজির হওয়ার তাওকীফ দিও। ফজরের আযান শেষে নামায আদায় করলাম। বাইতুল্লাহ এর দিকে তাকাতে তাকাতে বিদায় নিলাম।

তের.
হোটেলে এসে প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম। সকাল সাতটায় বাস ছাড়ল মদীনার উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার পাকিস্তানী। বেশ আরাম-দায়ক বাস। বাস ছুটা শুরু করল। কখনো ১১০ কখনো ১২০ কখনো ১৪০ কিলোমিটার বেগে। দুপাশের পাহাড়, মরুভুমি অতিক্রম করে বাস ছুটতে লাগল। কত রঙ্গের আর কত ঢঙ্গের যে পাহাড় আল্লাহ তাআলা বানিয়েছেন তা অত্যন্ত আনন্দের সাথে অবলোকন করছিলাম। মাঝে এক জায়গায় ২০ মিনিটের বিরতী দিল নাস্তার জন্য। বিরতীর পর আবার চলতে শুরু করল। একেক পাশেই চার লেন করে। ড্রাইভারদের মাঝে অভার টেকিং করার মনমানসিকতা খুবই কম। হঠাৎ মনে হল যেন উহুদ পাহাড়। তাইতো। যুল হুলাইফার সাইন বোর্ড দেখতে পেলাম। বাহ! এবার মাত্র পাঁচ ঘন্টার কম সময়েই চলে এসেছি। অথচ মনে আছে হজের সময়ে এই মদীনা থেকে মক্কা যেতে সকাল থেকে সন্ধা লেগে গিয়েছিল। দুরত্ব সাড়ে চারশ কিলোমিটার।
শেষমেষ মদীনাতে পৌছেই গেলাম। মসজিদে নববীর মিনার দৃষ্টিগোচর হল। ড্রাইভার অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে প্রত্যেককে তার হোটেলে নামিয়ে দিতে থাকলেন। আমাকে সর্বশেষ নামালেন। আমার হোটেল ছিল মসজিদে নববীর ২১ নং গেইট বরাবর উহুদ রোডে ঢাকা হোটেলের কাছে। সেখান থেকে মসজিদে নববীতে পায়ে হেটে যেতে মাত্র ৮/১০ মিনিট লাগে। যোহরের নামাযে মসজিদে যেতে পারিনি। আসরে চলে গেলাম মসজিদে নববীতে। শরীরে অন্যরকম একটা ভাব কাজ করছিল। কিন্তু শরীর ছিল খুব ক্লান্ত। তাই আবেগও ঠিকভাবে কাজ করছিল না। তাই আসরের পরে আর রওজায়ে আতহারে যাওয়া হয়নি। নামায পড়ে হোটেলে চলে এলাম। মাগরিবের নামাযের পর বাবুস সালাম দিয়ে সালাম পেশ করার জন্য প্রবেশ করলাম। বেশী ভিড়ের সময় মাঝপথে দুর দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়। আমাদেরকে দুর দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। (প্রিয় পাঠক এখন শারজা, দুবাই এয়ারপোর্টে বসে এগুলো লিখছি। কয়েক ঘন্টা পরেই দেশে ফিরব। দেশে ফিরার পরে ব্যস্ততা ভীষণ আকারে বেড়ে যাবে। লেখার সুযোগ হবে না। তাই স্বল্প পরিসরে শেষ করতে যাচ্ছি) বেশ দুর থেকে সালাম দিতে হল। মনে হল, জীবনটা কেমন যেন সার্থক হয়ে গেল। আমার শরীর থেকে অনেক বড় বোঝা হালকা হয়ে গেল। আমি ধন্য হলাম। আল্লাহ তাআলার অপার করূনার অবিরত বারিধারা আমার উপর আবার বর্ষিত হল।
কিন্তু দুর থেকে সালাম দেওয়ায় অতৃপ্তি রয়েই গেল। মন অস্থির ছিল। ভোর সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম মসজিদে নববীতে। বাবুস সালাম দিয়ে পুনরায় প্রবেশ করলাম। এবারো তা-ই হল। মাঝ পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার কারনে দূর থেকেই সালাম দিতে হল আবারো। অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। কিছু নফল নামায পড়ে প্রাণ খুলে দুআ করলাম।
এদিন ছিল জুমুআর দিন। ফজরের নামাযে যা মনে করেছিলাম ঠিক তাই। প্রথম রাকাআতে সেই হামীম সিজদাহ আর দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা ইনসান বা দাহর। পরে জুমুআর প্রস্তুতি নিয়ে ১০ টার পরেই মসজিদে চলে গেলাম। মসজিদে নববী কানায় কানায় ভরতে লাগল। জুমুআর দিন সাধারণত আশপাশের বিভিন্ন মানুষ এমনকি দূর দুরান্ত থেকেও অনেকে আসে জুমুআর নামায মসজিদে নববীতে আদায় করার জন্য। মদীনাতেও খতীব সাহেব জবানের হেফাযত সম্পর্কে লম্বা খুতবা দিলেন।
আসরে নামাযের পর রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম। আল্লাহ তাআলা আমাকে আবারো ধন্য করলেন। রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মিম্বার থেকে আয়েশা (রাঃ) এর হুজরা পর্যন্ত স্থানকে রিয়াজুল জান্নাত তথা জান্নাতের বাগান বলে। এ স্থানটুকুতে সাদা কার্পেট দেওয়া। অন্য জায়গায় লাল কার্পেট। এ জায়গা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما بين بيتي ومنبري روضة من رياض الجنة
অর্থঃ আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী অংশ জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্য থেকে একটি বাগান।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১১৯৫
অর্থাৎ উক্ত স্থানটুকু জান্নাতের একটি অংশ। সবার এই জায়গায় একটু প্রবেশের জন্য কি যে মরনপন চেষ্টা তা বুঝানোর উপায় নেই। হাদীস শরীফে আছে কেউ একবার জান্নাতে প্রবেশ করলে তা থেকে আর বের হবে না। এই দৃষ্টিকোন থেকে ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, কেউ উক্ত স্থানে প্রবেশ করলে সে আর জাহান্নামে যাবে না। সুবহানাল্লাহ। আসলে এটা তার একটি আবেগী মত। যাই হোক, সেখানে পা ফেলানোর কোন জায়গা ছিল না। সবার তামান্না থাকে উক্ত স্থানে প্রবেশ করে একটু নামায ও দুআর। অনেককেই দেখলাম নামায পড়ছে। অথচ আসরের পরে নফল নামায পড়া যায়েয নেই। কে কার কথা শুনে?
যাই হোক, খুব দুআ করলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। এবার সালাম পেশ করার জন্য বেরিয়ে গেলাম। সবচে নিকটতম স্থান থেকে সালাম দেওয়ার সুযোগ পেলাম। অত্যন্ত আবেগ ও ভক্তির সাথে সালাম পেশ করলাম। উক্ত স্থান থেকে কেউ সহজে সামনে বাড়তে চায় না। ভিতরে উকি দিয়ে দেখতে থাকে। চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। আমিও উকি দিতে থাকলাম। কোথায় শায়িত আমার রাসূল? কেমন তার রওজা? কেমন তার ঘর? ভিতরে কি আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন মনে উকি দিতে থাকে। কিন্তু পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে দেয় না। সেখানে পাঁচ সেকেন্ডও দাঁড়ানো কষ্টকর। মনটা এবার ঠান্ডা হল। পাশেই আল্লাহ তাআলার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই প্রাণপ্রিয় সাথী হযরত আবূ বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ)। তাদেরকেও ভক্তি মিশ্রিত সালাম করলাম। সালাম পেশ করে অপর দিকে যে দরজা দিয়ে বের হতে হয় তার নাম বাবুল বাকী। এ দরজা বরাবর সামনে গেলেই “বাকীউল গরকদ” কবরস্থান। যা আমাদের নিকট জান্নাতুল বাকী নামে প্রসিদ্ধ। এখানে অন্তত দশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের কবর রয়েছে। হযরত উসমান (রাঃ), হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও আহলে বাইত সহ অনেক আকাবেরে সাহাবায়ে কেরামের কবর এখানে রয়েছে। সোজা চলে গেলাম বাকীতে। ফজর ও আছরের পর এর দরজা যিয়ারতকারীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। কারো কবর নির্দিষ্ট করে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে আহলে বাইত সামনের অংশে এমনটা লোকমুখে শুনা যায়। অনুরূপভাবে বেশ কিছু কবর বড় করে বিশেষভাবে চিহ্নায়িত করা। অনুমান করা যায় এগুলো সাহাবাদের কেউ হবেন। উৎসুক মানুষের আগ্রহের কোন শেষ নেই। একের পর এক হাজারো প্রশ্ন। কে এখানে? এটা কার কবর? ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলিশের এক কথা আল্লাহ মালুম। এখানে মদীনা ইউনিভার্সিটির কিছু ছাত্রও ডিউটি করে। তারা বিভিন্ন ভাবে মানুষকে বুঝাচ্ছে।
যাই হোক, কবরবাসীদের সালাম দিলাম। তাদের জন্য দুআ করলাম। শরীর শিউরে উঠছিল, যখন ভাবছিলাম এখানে হাজার হাজার মহামনিষী সাহাবায়ে কেরাম শায়িত।
পরদিন সকালে যিয়ারতের জন্য বের হলাম। মসজিদে নববীর আশপাশ থেকে বিভিন্ন গাড়ি যায়। তারা যিয়ারাহ যিয়ারাহ বলে ডাকতে থাকে। একটি মাইক্রোবাসে উঠলাম। প্রত্যেককে দশ রিয়াল করে দিতে হবে। ড্রাইভার প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল উহুদের দিকে। যেখানে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেখানে নামলাম। এখানে রয়েছে উহুদের যুদ্ধে শহীদ হওয়া ৭০ জন সাহাবায়ে কেরামের কবর। এখানেই শায়িত রয়েছেন সায়্যিদুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ)। এ স্থানটি বর্তমানে সায়্যিদুশ শুহাদা নামেই পরিচিত। তাদের কবর যিয়ারত করলাম, তাদের বিনয় ও শ্রদ্ধা সম্বলিত সালাম পেশ করলাম। মূল উহুদ পাহাড় যুদ্ধ ময়দান থেকে আরো বেশ দূরে। যুদ্ধ ময়দানে রয়েছে জাবালে রুমা। যেখানে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) কে কয়েকজন তীরন্দাজের জিম্মাদার হিসেবে রাখা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল মসজিদে কিবলাতাইনের দিকে। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা কিবলা পরিবর্তনের আদেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ নামাযের কিছু অংশ হয়েছিল বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে আর কিছু অংশ কাবার দিকে ফিরে। এখানে কিছু নফল নামায আদায় করে দুআ করলাম।
এরপর রওনা হলাম মাসাজিদে সাবআর দিকে। সাবআ শব্দের অর্থ সাত। বাস্তবে এখানে রয়েছে ছয়টি মসজিদ। মসজিদে ফাতহ, মসজিদে সালমান, মসজিদে আবূ বকর, মসজিদে উমর, মসজিদে আলী ও মসজিদে সাদ বিন মুআজ। অতীতের ন্যায় এখনো এটাকে মাসাজিদে সাবআ বলা হয়। অবশ্য ২০০৩ সালে মসজিদে সালমান ফার্সী ও মসজিদে আবূ বকর ভেঙ্গে তদাস্থলে একটি বড় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে।
এরপর রওনা হলাম কুবার দিকে। মুসলমানদের প্রথম মসজিদ। এখানে নামাযের বিশেষ ফযীলাত রয়েছে, যা তার গেইটেও লিখা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
من تطهر في بيته ثم أتى مسجد قباء فصلى فيه صلاة كان له كأجر عمرة
অর্থঃ যে ব্যক্তি তার ঘর থেকে উযূ করে এসে মসজিদে কুবাতে নামায পড়বে তার আমলনামায় উমরার ন্যায় সাওয়াব লিখা হবে।–সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৪১২
অত্যন্ত চমৎকার মসজিদ। এখানে চার রাকাআত ইশরাকের নামায আদায় করলাম। এরপর দুআ করলাম। যিয়ারা শেষে ড্রাইভার আবার আমাদেরকে হারামে নামিয়ে দিয়ে গেল।
পরদিন ভাবলাম রিয়াজুল জান্নাতে এক ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে। মাগরিবের নামায শেষে হুড়পাড় করে গিয়ে রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করলাম। তিল পরিমান জায়গা নেই। সবাই নামায পড়ার চেষ্টা করছে। এরপর আবার সিজদা করার জায়গা নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
অর্থঃ আমি আপনার আলোচনাকে সমুন্নত করেছি।(সূরা শারহ, আয়াত ৪)
যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলার ঘরে সর্বদা মানুষের ভীড় থাকে তেমনিভাবে তার হাবীবের ঘরেও সর্বদা ভীড় লেগেই আছে। যেমন ভাবে আল্লাহ তাআলার ঘরের চারপাশে সর্বদা মানুষ পাগলের ন্যায় ঘুরছে। তেমনিভাবে তার হাবীবের ঘরের সামনেও সর্বদা মানুষ সালাম পেশ করেই যাচ্ছে। ওয়াহ, ওয়াহ, কি শান আমাদের প্রিয় পেয়ারা হাবীবের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)? শুনেছি এই সময় নাকি ডাল সিজেন। অর্থাৎ ওমরাকারীদের সংখ্যা একেবারেই কম থাকে, কোন ভীড় নেই, সবকিছু আসানীর সাথে করা যায় ইত্যাদি। অথচ হাতীমে ঢুকলাম প্রায় জীবনকে বিসর্জন দিয়ে, কখনো পারলাম না হাজরে আসওয়াদকে চুমু দিতে, সহজ ভাবে রিয়াজুল জান্নাতে কখনো পারলাম না প্রবেশ করতে, ভিড়মুক্ত কখনো পেলাম না রওজায়ে আতহার। এই যদি হয় ঢাল সিজেনের অবস্থা তবে অন্য সময় কি হবে বুঝে নিন।
আল্লাহ তাআলার দরবারে যেমন সর্বদা ভীড় তেমনিভাবে তার হাবীবের দরবারেও সর্বদা ভীড়। দেখলাম প্রত্যেকে নিজের সর্বস্বটুকু দিয়ে দুই রাকাআত নফল পড়ার চেষ্টা করছে। নামায পড়তে গিয়ে কেউ মাথায় পাড়া দিচ্ছে, কেউ মাথার উপর পড়ে যাচ্ছে। তাতে কি আসে যায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে (প্রায় চল্লিাশ মিনিট তো হবেই) একটু নামাযের সুযোগ পেলাম। ইচ্ছা হল ইশা পড়ে যাব। কিন্তু চার রাকাআত পড়ার পরেই পিছন থেকে অনুরোধ এল নামাযের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। প্রত্যেকে দুই রাকাআত নামায পড়েই চলে যায়। কেমন যেন সে ধন্য হয়ে গিয়েছে। অনেকে আবার একের পর এক নামাযের নিয়ত করেই যাচ্ছে। সে কাউকে সুযোগ দিবে না। পিছনে ক্ষুদ্ধ মানুষ বিভিন্ন কথা বলছে। তাকে কি?
অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত একটা নামাযের জায়গা স্থান করে নিলাম। প্রাণ খুলে দুআ করলাম। মুআজ্জিন আমাদের সামনেই আজান দিলেন। ইশার নামায শেষে পূনরায় সালাম দেওয়ার জন্য বের হলাম। বাম দিক ঘেষে রওজায়ে আতহারের নিকট দিয়ে চলতে থাকলাম। ভীড়ের চাপে মনে হচ্ছিল বুক ভেঙ্গে যাবে। খুব কাছ থেকে আবারো সালাম দিলাম। সর্বদা সালাম দেওয়ার সময় একটা ভয় কাজ করে। বিশেষ করে কাছ থেকে সালাম দেওয়ার সময় আরো বেশী ভয় কাজ করে। না জানি ভিতর থেকে সালাম গ্রহন না করার কোন আওয়াজ আসে কিনা? কত সুন্নাতই তো ছেড়ে দিচ্ছি। না জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারায কিনা? রওজার সামনে গেলে একেবারে ছোট বাচ্চার মত হয়ে যাই। ভিতরে উঁকি দিতে থাকি। দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করি।
প্রতিদিন প্রায় তিনবার সালাম পেশ করতাম। আর আসরের পরে বাকীতে ঢুকতাম। এভাবেই মদীনার দিনগুলো শেষ হয়ে গেল। প্রস্তুতি নিয়ে চলে এলাম। প্রিয় পাঠক আর লিখলাম না। একতো সময় নেই, দ্বিতীয়ত আগ্রহও নেই।

Loading