ফাযায়েলে আমালে যঈফ হাদীস গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। তবে এর জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। আর ক্ষেত্র বিশেষে আহকামেও যঈফ হাদীসের উপর আমল করা হয়।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনাবী (রহঃ) বলেন, জেনে রাখা উচিত যে, সনদের প্রয়োজনীয়তার দিক দিয়ে আহকাম এবং গায়রে আহকাম (যা আহকামের সাথে সম্পৃক্ত নয়) উভয়টি বরাবর। যার কোন সনদ নেই তা ধর্তব্য নয়। তবে উভয়ের মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আর তা হল হালাল হারাম সংক্রান্ত আহকামের হাদীসে কড়াকড়ি করা হয়। এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যঈফ সনদকে কবুল করা হয় কিছু শর্ত সাপেক্ষে যেগুলো উলামায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন।-আল-আজউবাতুল ফাযেলা, পৃষ্ঠা ৩৬
ইমাম আহমাদ সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন-
إذا روينا في الحلال والحرام شددنا وإذا روينا في الفضائل ونحوها تساهلنا
অর্থঃ যখন আমরা হালাল – হারামে রেওয়ায়েত করি (সনদে খুব) কড়াকড়ি করি। আর যখন ফযীলাত ইত্যাদির ক্ষেত্রে রেওয়ায়েত করি শিথিলতা করি।-হাফেয সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৯৮
মোল্লা আলী কারী (রহঃ) বলেন, যঈফ হাদীস ফাযায়েলে আমালে গ্রহণযোগ্য সমস্ত বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের নিকট।
তিনি অন্যত্র বলেন, ফাযায়েলে আমালে যঈফ হাদীসের উপর সর্বসম্মতিক্রমে আমল করা হবে। এজন্যই আমাদের আয়িম্মায়ে কেরাম বলেছে, মাথা মাসেহ করা সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব। – আলমাউজূআত, মোল্যা কারী, পৃঃ ৭৩
আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) বলেন, আমি ফাতোয়া দিয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতাকে তার জন্য জীবিত করা হয়েছিল এই মর্মে বর্ণিত হাদীসটি জাল নয়। যেমনটি হাফেযে হাদীসের একটি দল দাবী করেছেন। বরং তা ঐ পর্যাযের যঈফ হাদীস যাতে ফাযায়েলের ক্ষেতে বর্ণনা করতে শিথিলতা করা হয়। – আত তাযীম ওয়াল মিন্নাহ, সূয়ূতী, পৃষ্ঠা ২
উক্ত হাদীসটির ব্যপারে তিনি অন্যত্র বলেন উলামায়ে কেরাম এক্ষেত্রে তার সনদের দুর্বলতাকে ক্ষমাযোগ্য মনে করেন এবং ফাযায়েল ও মর্যাদার অধ্যায়ে যা সহীহ নয় এমন হাদীসের আনয়ন গ্রহনযোগ্য মনে করেন। আল-মাকামাতুস সুনদুসিয়্যাহ, সূয়ূতী, পৃষ্ঠা ৫
হাফেয ইরাক্বী (রহঃ) বলেন, যা জাল নয় তার সনদে শিথিলতা করা উলামায়ে কেরাম জায়েয বলেছেন এবং আহকাম ও আকায়েদ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা উল্লেখ করা ছাড়াই বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছেন। বরং ফাযায়েলে আমাল, ঘটনা, ওয়াজ ইত্যাদি বিষয়ের তারগীব ও তারহীবে অনুমতি দিয়েছেন। আর যদি তা হালাল – হারাম সম্বলিত আহকামে শরইয়্যাহ এর মধ্যে হয় অথবা আকায়েদে হয় যেমন আল্লাহ তাআলার ছিফাত এবং তার জন্য যা সম্ভব ও অসম্ভব ইত্যাদি তবে তারা তাতে শিথিলতা করেন না। ইমামদের মধ্য থেকে যারা এমনটি বলেছেন তাদের অন্যতম হলেন আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী, আহমাদ ইনবে হাম্বল এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক সহ অন্যান্যরা। – শরহু আল ফিয়াতিল হাদীস, হাফেয ইরাক্বী, ২/২৯১
আল্লামা নববী (রহঃ) বলেন-
ويجوز عند أهل الحديث وغيرهم التساهل في الأسانيد ورواية ما سوى الموضوع من الضعيف والعمل به من غير بيان ضعفه في غير صفات الله تعالى والأحكام
অর্থঃ হাদীস বিশারদকারীদের নিকট যঈফ সনদ সমূহে শিথিলতা করা এবং জাল ছাড়া দুর্বল হাদীসের দুর্বলতা উল্লেখ করা ব্যতীত বর্ণনা করা জায়েয। আর তার উপর আমল করা বৈধ। যখন তা আহকাম এবং আল্লাহ তা’য়ালার ছিফাতের ব্যাপারে না হয়। -তাক্বরীবে নববী, পৃষ্ঠা ১৯৬
তবে এ কথাও স্বতসিদ্ধ যে ফাযায়েলে আমালে সকল প্রকার দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এর একটি সহনীয় মাত্রা রয়েছে। উলামায়ে কেরাম যঈফ হাদীস ফাযায়েলে আমালে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত উল্লেখ করেছেন।
হাফেয সাখাবী (রহঃ) বলেন-
سمعت شيخنا ابن حجر مرارا يقول شرائط العمل بالحديث الضعيف ثلاثة
الأول متفق عليه وهوأن يكون الضعف غير شديد كحديث من انفرد من الكذابين والمتهمين ممن فحش غلطه
والثاني أن يكون مندرجا تحت أصل عام فيخرج ما يخترع بحيث لا يكون له أصل أصلا
والثالث أن لا يعتقد عند العمل ثبوته لئلا ينسب إلى النبي {صلى الله عليه وسلم} ما لم يقله
অর্থঃ আমি আমার শায়েখ ইবনে হাজার আসক্বালানীকে বহুবার বলতে শুনেছি যঈফ হাদীসের উপর আমলের জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে।
এক. সর্বস্বীকৃত আর তা হল দুর্বলতা মারাত্মক পর্যায়ের হতে পারবে না। এর দ্বারা ঐ সকল (দুর্বল) রেওয়ায়েত বের হয়ে গেল যা একক ভাবে কোন মিথ্যুক, অপবাদ আরোপকৃত ব্যক্তি এবং যার ভুল বেশী হয় এমন ব্যক্তি রেওয়ায়েত করে।
দুই. সাধারণ কোন মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত হবে। এর ফলে ঐ সকল উদ্ভাবন বের হয়ে গেল যার শরীআতে কোন ভিত্তি নেই।
তিন. তার উপর আমল করার সময় (অকাট্যভাবে) তা প্রমানীত হওয়ার বিশ্বাস না রাখা। যাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এমন কিছু সম্বন্ধ যুক্ত না করা হয় যা তিনি বলেন নি। – আল কওলুল বদী, হাফেয সাখাবী পৃষ্ঠা ১৯৫
উপরের আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে আহকাম ও আকায়েদ ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে যঈফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। বিশেষভাবে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে।
বরং আহকামেও যঈফ হাদীসের উপর আমল করা হয় যখন তার মধ্যে সতর্কতা থাকে। আর পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে কোন যঈফ হাদীসকে উত্তত যখন কবুলের দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তখন তা সহীহ এর কাতারে চলে যায় এবং তার উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
কিন্তু আফসোসের বিষয় আমাদের মধ্যে এক শ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ যারা স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিগতভাবে লেখাপড়া করেই দ্বীন পেতে চায় এবং দ্বীনের কর্ণধার হতে চায় তারা যখন কোন হাদীসের ব্যপারে যঈফ শব্দটি শুনতে পায়, তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তারা মনে করে যঈফ হাদীসকে সর্বদা ছেড়ে দেওয়াই অটল একটি সিদ্ধান্ত। অথচ এটা পূর্ববতি এবং পরবর্তি সকল উলামা এবং মুহাদ্দিসীনদের মূলনীতি পরিপন্থি। এক্ষেত্রে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) এর একটি উক্তি স্বর্ণাক্ষরে লিখার মত যা তার অন্যতম যোগ্য শাগরেদ আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহঃ) নকল করেছেন। তিনি বলতেন “সনদের প্রয়োজনীয়তা এ জন্য যে যাতে দ্বীনের মধ্যে এমন জিনিস প্রবেশ করতে না পারে যা দ্বীনের অন্তভুক্ত নয়। এজন্য না যে, যারা সনদ নিয়ে গবেষণা করেন তাদের কর্মে প্রমানীত বিষয় দ্বীন থেকে বের হয়ে যায়”।
অর্থাৎ সনদ নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা আমাদের পূর্ববর্তিগণ এজন্য করেছেন যাতে বানোয়াট জিনিস দ্বীনে প্রবেশ না করতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে দ্বীনী বিষয়কে দ্বীন থেকে বের করে দেওয়া।