বর্তমানে গুনাহের প্রতিযোগিতার এ যুগে বিজাতীয়দের বহুমুখী ইসলামী চেতনা বিরোধী আগ্রাসন আমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে রেখেছে। আর মুসলমানও তাদের প্রতিটি কদমে কদমে অনুসরণ করে যাচ্ছে। অথচ হাদীস শরীফে প্রতিটি কাজে তাদের বিরোধীতা করতে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
خالفوا اليهود والنصارى
অর্থঃ তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদের বিরোধিতা কর।–সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ২১৮৬
خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ
অর্থঃ তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা কর।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৮৯২
قَالَ لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ
অর্থঃ তোমরা অবর্শ্যই পূর্ববতীদের রীতিনীতি অনুসরণ করবে প্রতিটি বিঘতে বিঘতে, প্রতিটি হাতের দৈর্ঘ্যে। এমনকি তারা কোন গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করলে (তাদের অনুসরণে) তোমরাও প্রবেশ করবে। তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইয়াহুদী নাসারা (দের কথা বলছেন)? তিনি বললেন, তারা ছাড়া আর কে?-সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৩৪৫৬
অন্য হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন –
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
অর্থঃ যে ব্যক্তি যে জাতির অনুসরণ করে সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে।–সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪০৩৩
অথচ আজ আমাদের মাঝে “ভ্যালেন্টাইনস ডে” নামক তাদেরই অশ্লীল নোংরা অপসংস্কৃতি এমন ভাবে সাওয়ার হয়েছে তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। যিনা, ব্যভিচার, মদ্যপান, মাদক সেবন, অশ্লীলতা, নোংরামী কি হয় না এই দিনকে ঘিরে? এই দিবস যুব সমাজকে বিবাহ পূর্ব অবৈধ নর-নারীর সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহিত করছে। প্রথমে আমরা এ দিবসের শুরুর ইতিহাস, উৎপত্তি বা গোড়ার কথা জেনে নিই। পরে শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে আমরা তা পর্যালোচনা করব ইংশাআল্লাহ।
কী এই ভ্যালেন্টাইনস ডে? কীভাবে তার উত্পত্তি? কেনইবা একে ঘিরে ভালোবাসা উত্সবের আহ্বান? ইতিহাসে এ ব্যাপারে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ইতিহাসটি হচ্ছে ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপি এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারক। আর রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ছিলেন বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় বিশ্বাসী। সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করায় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। এক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। অনেকক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত। একসময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিত্সায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা ও তার প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালোবাসার কথা সম্রাটের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
আরেকটি খ্রিস্টীয় ইতিহাস মতে, গোটা ইউরোপে যখন খ্রিস্টান ধর্মের জয়জয়কার, তখনও ঘটা করে পালিত হতো রোমীয় একটি রীতি। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের সকল যুবকরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুটে লিখে একটি পাত্রে বা বাক্সে জমা করত। অতঃপর ওই বাক্স হতে প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যার হাতে যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবত্সর ওই মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখত, এ বলে ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি।’ বছর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হতো। এ রীতিটি কয়েকজন পাদ্রীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উত্পাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খ্রিস্টান ধর্মায়ণ করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খ্রিস্টান নিদর্শন, যাতে এটা কালক্রমে খ্রিস্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।(সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ইং)
এ বিষয়ে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. খালিদ বেগে বলেন-
‘‘আজকাল অনেক মুসলিমই প্রকৃত বিষয়টি না জেনে নানা রকম বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করে থাকে। তারা কেবল তাদের সাংস্কৃতিক নেতাদের মতোই এসব ক্ষেত্রে অন্ধ অনুসারী। তারা এটি খুবই কম উপলব্ধি করে যে, তারা যা নির্দোষ বিনোদন হিসেবে করে তার শিকড় আসলে পৌত্তলিকতায়, যা তারা লালন করে তা হলো অবিশ্বাসেরই প্রতীক। তারা যে ধারণা লালন করে তা কুসংস্কার থেকেই জন্ম। এমনকি ইসলাম যা পোষণ করে এসব তার প্রত্যাখ্যান। ভালোবাসা দিবস আমেরিকা ও ব্রিটেন বাদে গোটা ইউরোপে মৃত হলেও হঠাৎ করেই তা মুসলিম দেশগুলোয় আবার প্রবেশ করছে। কিন্তু কার ভালোবাসা? কেন এ দিবস পালিত হবে?
অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে তারা যেমন করে, এ বিষয়েও কথিত আছে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে উর্বরতা ও পশুর দেবতা বলে খ্যাত লুপারকাসের (Lupercus) সম্মানে পৌত্তলিক রীতিনীতির একটি অংশ হিসেবে রোমানরা ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন শুরু করে। এর মূল আকর্ষণ হলো পরবর্তী বছরের লটারির আগ পর্যন্ত বর্তমান বছরে লটারির মাধ্যমে যুবকদের মাঝে যুবতীদের বণ্টন করে দেয়া। এ দিন উদযাপনে অন্যান্য ঘৃণ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি ছিল, এক টুকরো ছাগলের চামড়ায় আবৃত যুবতীদের দু’জন যুবক কর্তৃক উৎসর্গকৃত ছাগল ও কুকুরের রক্তে ভেজা চাবুক দিয়ে প্রহার করা। মনে করা হতো ‘পবিত্র যুবক’দের প্রতিটি ‘পবিত্র’ আঘাত দ্বারা ওই সব যুবতী ভালোভাবে সন্তান ধারণে সক্ষম হবে।
খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যথারীতি লুপারকালিয়ার (Lupercalia) এ ঘৃণ্য রীতিকে বন্ধ করার বৃথা চেষ্টা করল। প্রথমে তারা মেয়েদের নামে লটারির বদলে ধর্মযাজকদের নামে লটারির ব্যবস্থা চালু করল। এর উদ্দেশ্য হলো, যে যুবকের নাম লটারিতে উঠবে সে যেন পরবর্তী একটি বছর যাজকের মতো পবিত্র হতে পারে। কিন্তু খ্রিষ্টানরা খুব কম স্থানেই এ কাজে সফল হলো।
একটি জনপ্রিয় খারাপ কাজকে কিছু পরিবর্তন করে তাকে ভালো কাজে লাগানোর প্রবণতা বহু পুরনো। তাই খ্রিষ্টানরা শুধু লুপারকালিয়া থেকে এ উৎসবের নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন করতে পারল। পোপ গ্যালাসিয়াস (Gellasius) ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে এটি করল। তথাপি খ্রিষ্টান কিংবদন্তিতে ৫০-এরও বেশি বিভিন্ন রকম ভ্যালেন্টাইন আছে। এদের মধ্যে মাত্র দু’জন সবচেয়ে বেশি পরিচিত, যদিও তাদের জীবন ও চরিত্র এখনো রহস্যাবৃত। একটি কিংবদন্তি হলো, যেটি বেশি প্রকৃত ভ্যালেন্টাইন দিবসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন হলেন ‘প্রেমিকদের যাজক’- যে নিজেকে কারাগারের প্রধানের মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে ফেলেন।
কিন্তু কিছু মারাত্মক অসুবিধার জন্য ফ্রান্স সরকার উল্লিখিত লটারি ১৭৭৬ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কাল পরিক্রমায় এটি ইতালি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানি থেকেও উঠে যায়। এর আগে সপ্তদশ শতাব্দীতে পিউরিটানরা যখন শক্তিশালী ছিল সে সময় ইংল্যান্ডে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় চার্লস এটি ১৬৬০ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইংল্যান্ড থেকেই এটি নতুন বিশ্বে আগমন করে যেখানে এটিকেই টাকা বানানোর ভালো মাধ্যম হিসেবে নিতে ইয়াংকিরা (আমেরিকানরা) উদ্যোগী হয়। ১৮৪০ সালের দিকে ইস্টার এ হল্যান্ড ‘হোয়াট এলস ভ্যালেন্টাইন’ (What else Valentine) নামে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকান ভ্যালেন্টাইন ডে কার্ড বানায় এবং প্রথম বছরই ৫০০০ ডলারের কার্ড বিক্রি হয় (তখন ৫০০০ ডলার অনেক)। সে থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে ফুলে ফেঁপে ওঠে।
এটি হ্যালোইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ ভূত এবং অপদেবতার মতো পোশাকে সজ্জিত হয়ে পৌত্তলিকদের একটি প্রাচীন শয়তান পূজার পুনঃপ্রচলন করে। পৌত্তলিকেরা এর নাম দেয় সামহাইন (Samhain) যা সোয়েন (Sowen) হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমনটি ভ্যালেন্টাইন ডে’র ক্ষেত্রে ঘটেছিল। খ্রিষ্টানরা এর নাম পরিবর্তন করে ঠিকই, কিন্তু পৌত্তলিক শিকড় পরিবর্তন করতে পারেনি। দৃশ্যত নির্দোষ অনুষ্ঠানেরও পৌত্তলিক শিকড় থাকতে পারে। পূর্বকালে মানুষ ভূতপ্রেতকে ভয় পেত, বিশেষভাবে তাদের জন্মদিনে। একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, মন্দ প্রেরণা একজন ব্যক্তির জন্য অধিক বিপজ্জনক যখন কেউ প্রাত্যহিক জীবনে একটি পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যেমন জন্মদিনে বা একটি বছরের শুরুতে। কাজেই সে ব্যক্তির পরিবার ও চার পাশের বন্ধুবান্ধব হাসি-আনন্দের মাধ্যমে জন্মদিনে তাকে মন্দ থেকে রক্ষা করত, যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়।
কী করে একজন সচেতন মানুষ ভাবতে পারে ইসলাম অনৈসলামিক ধারণা এবং বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত অযৌক্তিক আচার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে?…
এটি একটি বিশাল ট্র্যাজেডি যে মিডিয়ার মাধ্যমে নিত্য বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক অপপ্রচারে মুসলমানেরা ভালোবাসা দিবস (Valentine day) হেলোইন (Halloween) এবং এমনকি সান্তাক্লজকেও (Sant claus) আলিঙ্গন করে নেয়।’’ (সুত্রঃ ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন, মার্চ ২০০১)
বর্তমানে গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকা ছাড়া আর কোথাও এ দিবসটি তেমন ভাবে পালিত হয় না। কিন্তু কেমন করে যেন আমাদের উপর এ মুসীবতটি চেপে বসেছে। আমাদের দেশে এ দিবসটির সূচনা করেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। ১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে তার মাধ্যমে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তার অফিসের সামনে একটি সড়কের নামকরণও করেন ‘লাভ লেন’। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণায় একমাত্র তিনিই সরব ছিলেন। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’। এখন বাংলাদেশে এ দিবস পালিত হয় ব্যাপক পরিসরে, নানা আয়োজনে। জানা যায়, শফিক রেহমানকে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নির্বাসিত থাকতে হয়েছিল। সে সময় তিনি সেখানে ‘ভালোবাসা দিবস’ উৎযাপন হতে দেখেছেন। লন্ডনে নব্বইয়ের দশকে খুব বেশি উদ্যাপিত হওয়া শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন ডে। বাণিজ্যিক কারণে হলেও সেখানকার স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকারা দিবসটিকে সাদরে গ্রহণ করেন। ওই সময়ই শফিক রেহমান সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশে ফিরে আসার পর দিনটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবেন। তবে বাংলাদেশে শুরু করার আগে লন্ডনে প্রচলিত ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ থেকে শুরুর ‘সেন্ট’ শব্দটি ধর্মীয় কারণে বাদ দেওয়া হয়। এটি ‘ভালোবাসার দিন’ হিসেবে প্রচার শুরু হয় তৎকালীন যায়যায়দিন পত্রিকায়। সে থেকে এই আমাদের দেশে দিনটির শুরু।(সুত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং)
উপরের আলোচনা থেকে আমরা ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হলাম। এর গোড়ায় রয়েছে দেব দেবতার নাম, পৌত্তলিকতা, শিরক, কুসংস্কার। কাজেই যার সাথে ঈমান বিরোধী এতগুলো উপকরণ যুক্ত তা কমপক্ষে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কিভাবে পালিত হতে পারে?
এই দিনে তরুন তরুণী ভালোবাসা আদান প্রদানের নামে সাক্ষাত, কথোপকথন, মদ্যপান, কনসার্ট, অবৈধ সংস্পর্শ কত কি-ই না করে থাকে? অনেকে তো নিজের সতীত্ব নষ্ট করার জন্য এ দিনটি ধার্য্য করে থাকে। এছাড়া গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, টি এস সি প্রাঙ্গন সহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় কত কি যে ঘটে থাকে তা সবারই জানা। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন –
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
অর্থঃ আর যিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীলতা এবং কতই না নিকৃষ্ট কাজ।– সূরা ইসরা, আয়াত ৩২
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
১। ব্যভিচারী পুরুষ ও ব্যভিচারিণী নারীদেরকে মৃত্যুর পর তন্দুরের ন্যায় একটি গর্তের মধ্যে আযাব দেওয়া হবে। যার মুখ সরু কিন্তু অভ্যন্তরভাগ অত্যন্ত গভীর ও প্রশস্ত। তার মধ্যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। আর তারা সেই আগুনে দগ্ধীভূত হতে থাকবে। আগুনের তেজ এত বেশী হবে যে, কেমন যেন আগুনের ঢেউ খেলতে থাকবে। ঢেউয়ের সাথে যখন আগুন উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার মধ্যে অবস্থিত লোকগুলো উথলে এসে গর্তের মুখের দিকে পৌঁছে গর্ত থেকে বের হয়ে যাবার উপক্রম হয়ে যায়। আবার আগুন নীচের দিকে নেমে গেলে তারাও আগুনের সাথে নীচের দিকে নেমে যায়। আর এই আযাব কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে দেওয়া হবে।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১৩৮৬
২। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আল্লাহ তাআলা তার সকল সৃষ্টির প্রতি নজর দেন। অতঃপর যারা আল্লাহ তাআলার কাছে মাফ চান তাদের সকলকে মাফ করে দেন, তবে ব্যভিচারীদের আল্লাহ তাআলা মাফ করেন না।–আলকামেল লিইবনি আদী ৪/৩৫৬ (শামেলা)
৩। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আমার উম্মতের আমলসমূহ আমার নিকট প্রতি সপ্তাহে উপস্থাপন করা হয়। আল্লাহ তাআলার ক্রোধ ব্যভিচারীদের উপর কঠিনতর হয়।–হিলয়াতুল আউলিয়া ৪/২৯৩
এছাড়াও হাদীস শরীফে কোন গাইরে মাহরাম মহিলার দিকে তাকানোকে চোখের যিনা, তাকে স্পর্শ করাকে হাতের যিনা, তার প্রতি অগ্রসর হওয়াকে পায়ের যিনা, চুম্বন করাকে ঠোঁটের যিনা এবং কথা বলাকে জিহ্বার যিনা বলে অভিহিত করা হয়েছে।– সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৬২৪৩; শুআবুল ঈমান, হাদীস নং ৭০৬০।
فَزِنَا الْعَيْنَيْنِ النَّظَرُ وَزِنَا الْيَدَيْنِ الْبَطْشُ وَزِنَا الرِّجْلَيْنِ الْمَشْيُ وَزِنَا الْفَمِ الْقُبَلُ
অর্থঃ দুই চোখের যিনা হল (কোন গাইরে মাহরাম মহিলার দিকে) তাকানো, দুই হাতের যিনা হল স্পর্শ করা, দুই পায়ের যিনা হল (তাকে উদ্দেশ্য করে) হাঁটা এবং ঠোঁটের যিনা হল চুম্বন করা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ১০৯২০।
তাই প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য এ দিবস পালন করা থেকে বিরত থাকা এবং এর অশ্লীলতা থেকে নিজেকে হেফাজত করা ঈমানী দ্বায়িত্ব। এ দিনকে কেন্দ্র করে যা কিছু ঘটে থাকে তাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করা ঈমান হরণের কারণ হতে পারে।
তাছাড়া যৌক্তিক দিক দিয়েও এর অসারতা একেবারে স্পষ্ট। কেননা বিবাহ পূর্ববতী তরুন তরুণীদের বা কোন গায়রে মাহরামের সাথে দেখা সাক্ষাত, কথা-বার্তা, প্রেম নিবেদন ইত্যাদি নাজায়েয ও হারাম হলেও মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতী ইত্যাদি আত্মীয় স্বজনের জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করা ইসলামে কাম্য। বরং তা আল্লাহর জন্য হলে ঈমানের অন্যতম আলামতও বটে। এখন এই বৈধ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য যদি ঘটা করে একটি দিবসই পালন করতে হয় তবে অন্যান্য দিন কি হবে? অন্যান্য দিনে কি ভালোবাসা প্রকাশ করা যাবে না? এর দ্বারা একটি অনন্ত ও সর্বজনীন বিষয়কে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হল না? যদি উত্তরে বলা হয়, এই দিনে একটু বেশী ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে তবে অন্যান্য দিনে কি কম ভালবাসা প্রকাশ করতে হবে? যদি যুক্তি দেখানো হয়, এই দিনে ভালোবাসা শিখতে হবে বা এই দিনে ভালোবাসায় উজ্জীবিত হয়ে সারা বছর সেভাবে চলতে হবে। তাহলে সারা বছর ভালোবাসা শিখতে বা ভালোবাসায় উজ্জীবিত হতে অসুবিধা কোথায়? এগুলো এজন্যই বলছি কারন অনেকের নিকটিই এ ধরনের যুক্তির মূল্য কম নয়। এ দিবসটির মূল্যায়নে আরো কত পাগলের কত পাগলামি যে ঘুরপাক খায় তার কোন ইয়াত্তা নেই। আরে ইসলামের ভিত্তিই তো ভালোবাসার উপর। আর তা লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা মুক্ত। আজীবন, কিয়ামত পর্যন্ত। শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলারই জন্য। হাদীস শরীফে এসেছে-
কেউ যদি কাউকে আল্লাহ তাআলার জন্যই ভালবাসে তবে সে তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করল।–সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪৬৮৩
অন্য হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তাআলার জন্য একে অপরকে যারা ভালোবাসে তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার আরশের ছায়াতলে থাকবে। যেদিন আল্লাহ তাআলার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৬৬০
তাই আসুন আমরা আল্লাহ তাআলার দুশমন ইয়াহুদী, নাসারা, মুশরিক সর্বোপরি অমুসলিমদের উদ্ভাবিত সকল অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে পূর্ণাঙ্গরূপে শান্তি ও ভালোবাসার ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে প্রবেশ করি। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থঃ আর যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন ৷” (সূরা আল ইমরান, আয়াত ৮৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ ধরণের গোমরাহী থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।