(বাংলা) সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বাইরে কি কোন সহীহ হাদীস নেই?
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বাইরে কি কোন সহীহ হাদীস নেই?
অনেকে মনে করেন সহীহ হাদীস শুধু মাত্র বুখারী ও মুসলিমে সীমাবদ্ধ। এ দুটির বাইরে কোন সহীহ হাদীস নেই। তাই যখন এ দুই কিতারে বাইরের কোন হাদীস তাদের সামনে পেশ করা হয় সাথে সাথে যঈফ বলে উড়িয়ে দেন। অথচ এটি একটি শতভাগ ভুল ধারণা। খোদ ইমাম বুখারী এবং মুসলিম থেকে উক্ত ধারণার বিপরীতে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
অর্থঃ হাফেয আবূ বকর হাযেমী (রহঃ) তার থেকে বুখারী (রহঃ) পর্যন্ত সংযুক্ত সনদে বর্ণনা করেন, বুখারী (রহঃ) বলেন-
لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا وما تركت من الصحيح أكثر
আমি এই কিতাবে সহীহ হাদীস ছাড় অন্য কোন হাদীস আনিনি আর আমি যে সকল সহীহ হাদীস ছেড়ে দিয়েছি তা অনেক বেশি।- শুরূতুল আয়িম্মাতিল খমসাহ, আল্লামা হাযেমী, পৃষ্ঠা ৪৯
বুখারী (রহঃ) অন্যত্র বলেন-
ما أدخلت في كتاب الجامع إلا ما صح وتركت من الصحاح مخافة الطول
অর্থঃ আমি আমার জামে নামক কিতাবে কেবল সহীহ হাদীসই এনেছি। আর অনেক সহীহ হাদীসকে ছেড়ে দিয়েছি কিতাব লম্বা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। – সিয়ারু আলামিল নুবালা, হাফেয যাহাবী ১০/৯৬; তাদরীবুর রাবী, আল্লামা সুয়ূতী, পৃষ্ঠা ৪৬।
অনরূপভাবে ইমাম মুসলিম (রহ) তার সহীহতে স্বয়ং তিনি বলেন, যে সকল হাদীস আমার নিকট সহীহ তার সবগুলো আমি এখানে আনিনি। বরং আমি এখানে ঐ সকল হাদীস এনেছি যার (সহীহ হওয়ার) উপর আমার উস্তাদবৃন্দ একমত হয়েছেন।- সহীহ মুসলিম, নামাযের মধ্যে আত্তাহিয়্যাতুর অধ্যায় ৪/১২২ (৯৩২ নং হাদীসের আলোচনায়)
তাছাড়া ইমাম বুখারী (রহঃ) এর সহীহের নামকরণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি তার কিতাবের নাম রেখেছেন-
الجامع المسند الصحيح المختصر من أمور رسول الله وسننه وأيامه
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিষয়াবলী এবং সুনান সম্বলিত সহীহ হাদীসের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন।
দেখুন তিনি নিজেই বলেছেন তার সহীহ কিতাবটি সহীহ হাদীসের একটি সংক্ষিপ্ত আকারের সংকলন। সুতরাং তার নিকটও এছাড়া আরো বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।
বুখারী (রহঃ) বলেন-
أخرجت هذا الكتاب يعني “الصحيح”من زهاء ست مئة ألف حديث.
অর্থঃ আমি এই কিতাব অর্থাৎ সহীহুল বুখারীর হাদীসগুলো প্রায় ছয় লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে এনেছি। – তাহযীবুল কামাল, আল্লামা মিজ্জী ২৪/৪৪২ (শামেলা); সিয়ারু আলামিন নুবালা, হাফেয যাহাবী ১২/৪০২।
অনুরূপভাবে মুসলিম (রহঃ) বলেন-
صنّفت هذا المسند الصّحيح من ثلاثمائة ألف حديثٍ مسموعة
অর্থঃ আমি এই সহীহ মুসনাদ কিতাবকে সংকলন করেছি তিন লক্ষ শ্রবনকৃত হাদীস থেকে। – তারীখুল ইসলাম, হাফেয যাহাবী ২০/১৮৬, তারীখে বাগদাদ ১৩/১১৮
তাহলে ইমাম বুখারী (রহঃ) ছয় লক্ষ হাদীস থেকে মাত্র ৭২৭৫ টি হাদীস তার সহীহতে এনেছেন। এছাড়াও তার কাছে আরো কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ একানব্বই হাজার সাত শত পচিশটি হাদীস ছিল। তবে সেগুলোর একটিও কি সহীহ ছিল না? অনুরূপভাবে মুসলিম (রহঃ) তিন লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে প্রায় আট হাজার হাদীস তার সহীহতে এনেছেন। তাহলে বাকী দুই লক্ষ বিরানব্বই হাজার হাদীসের মধ্যে একটিও কি সহীহ ছিল না?
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন-
صح من الحديث سبع مئة ألف حديث وكسر
অর্থঃ সহীহ হাদীসের সংখ্যা সাত লক্ষের কিছু বেশি। – তারিখে বাগদাদ ১০/৩৩২; সিয়ারু আলামিন নুবালা, হাফেয যাহাবী ১৩/৬৯
ইমাম শাফী (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন-
من قال إن السنة كلها اجتمعت عند رجل واحد فسق ومن قال إن شيئا منها فات الأمة فسق
অর্থঃ যে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমস্ত হাদীস এক ব্যক্তির কাছে একত্রিত হয়েছে সে ফাসিক। আর যে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের কোন অংশ উম্মত থেকে ছুটে গিয়েছে সেও ফাসিক। – তাওযীহুল আফকার ১/৫৫
আল্লামা হাযেমী (রহঃ) বুখারী (রহঃ) এর সহীহুল বুখারী সংকলনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বুখারী (রহঃ) এর সনদে বলেন-
قال كنت عند إسحاق بن راهويه فقال لنا بعض أصحابنا لو جمعتم كتابا مختصراً لسنن النبي صلى الله عليه وسلم فوقع ذلك في قلبي فأخذت في جمع هذا الكتاب
অর্থঃ বুখারী (রহঃ) বলেন আমি ইসহাক বিন রাহওয়াইহ এর নিকট ছিলাম। আমাদের কোন এক সাথী বলল যদি তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত সমূহের একটি সংক্ষিপ্ত কিতাবে সংকলন করতে। অতঃপর এটা আমার অন্তরে বসে গেল। ফলে আমি এই কিতাবটি সংকলন শুরু করে দিলাম।
অতঃপর হাযেমী (রহঃ) বলেন, এর দ্বারা স্পষ্ট হল বুখারী (রহঃ) এর উদ্দেশ্য ছিল সংক্ষিপ্ত ভাবে হাদীস সংকলন করা। তিনি সমস্ত সহীহ হাদীস আনার ইচ্ছা পোষণ করেন নি। না বর্ণনাকারীর বিবেচনায় না হাদীসের বিবেচনায়। – শুরূতিল আয়িম্মাতিল খমসাহ, পৃষ্ঠা ৫০।
ইমাম বুখারী এবং মুসলিম (রহঃ) তাদের সহীহ কিতাবে শুধুমাত্র সহীহ হাদীস আনার কারণে একদল লোক মনে করবে সহীহ হাদীস শুধুমাত্র এই দুই কিতাবে সীমাবদ্ধ এর বাইরে কোন সহীহ হাদীস নেই এমন আশংকা প্রায় বারশত বছর পূর্বেই পাহাড়তুল্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম অনুভব করতে পেরেছিলেন। আবূ যুরআ রাযী (রহঃ) যখন মুসলিম (রহঃ) এর কিতাবটি সম্পর্কে জানতে পারলেন তখন তিনি বললেন মুসলিমের এই কাজ আমাদের বিরুদ্ধে বিদআতিদের ক্ষেপিয়ে তুলবে। যখন তাদের বিরুদ্ধে কোন হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা হবে তখন তারা একথা বলে সুযোগ নিবে এটা তো সহীহ হাদীসের কিতাবে নেই। এরপর তিনি উক্ত কিতাব সংকলনকারীর উপর ভৎসনা করেন।
এরপর মুসলিম (রহঃ) রায় নামক শহরে আসেন এবং মুহাম্মাদ বিন মুসলিম বিন ওয়ারাহ এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এই কিতাব সংকলনের জন্য মুসলিম (রহঃ) এর উপর রুঢ় হন এবং তাকে ভৎসনা করেন। আর আবূ যুরআ তাকে যা বলেছিলেন তিনিও তাই বললেন। অতঃপর মুসলিম (রহঃ) তার নিকট ওযর পেশ করে বললেন, আমি এই সহীহ হাদীস সংকলন করেছি যাতে আমার নিকট এবং যে আমার থেকে হাদীস লিখবে তার নিকট সহীহ হাদীসের একটি ভান্ডার থাকে এবং সে তার সহীহ হওয়ার ব্যপারে কোন সন্দেহ না করে। আর আমি একথা বলিনি যে, এই কিতাবের বাইরে যা রয়েছে সব যঈফ। মুসলিম (রহঃ) এ ধরনের আরো কিছু কথা বলে তার কাছে ওযরখাহী করতে লাগলেন। তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং তাকে হাদীস বর্ণনা করলেন। – তারিখে বাগদাদ ৪/২৭৩, ২৭৪; শুরূতিল আয়িম্মাতিল খমসাহ, পৃষ্ঠা ৬০-৬৩
উপরের আলোচনা থেকে একথা দিবা লোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে বুখারী ও মুসলিমের বাহিরেও অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে। বরং এভাবে বলা যায় সহীহ হাদীসের বিশাল ভান্ডারের একটি অংশ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। নিম্নে আমরা এমন কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করছি যেগুলোর সংকলনকারীগণ বুখারী ও মুসলিমের মত কিতাবে সহীহ হাদীস আনার নীতি অবলম্বন করেছেন। তবে তারা তাদের নীতির উপর কতটুকু অটল থাকতে পেরেছেন সেটা ভিন্ন কথা।
০১। মুআত্তা মালেক
০২। সহীহ ইবনে খুযাইমা (৩১১ হিঃ)
০৩। সহীহ ইবনে হিব্বান (৩৫৪ হিঃ)
০৪। মুস্তাদরাকে হাকেম (৪০৫ হিঃ)
০৫। কিতাবুল ইলযামাত, দ্বারা কুত্বনী (৩৮৫ হিঃ)
০৬। আল মুখতারাহ, জিয়াউদ্দীন মাক্বাদিসী (৬৪৩ হিঃ)
০৭। সহীহ আবূ আওয়ানাহ
০৮। সহীহ ইবনুস সাকান (৩৫৩ হিঃ)
০৯। আল-মুনতাকা, ইবনুল জারূদ (৩০৭ হিঃ)
১০। আল মুনতাক্বা, কাসেম ইবনে আসবাগ (৩৪০ হিঃ)
১১। কিতাবুল আসার, আবূ হানীফা
এছাড়াও সুনানে নাসাঈ, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজী, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে বাইহাক্বী, আল মু’জামুল কাবীর/ আউসাত/ ছগীর, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে দ্বারাকুত্বনী, সুনানে দ্বারেমী, সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর, শুআবুল ঈমান, মুসনাদে আবূ দাউদ ত্বয়ালিসী, মুসনাদে আবূ ইয়ালা, মুসনাদে বাযযার, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এবং মুসতাখরাজাত সহ আরো অসংখ্য হাদীসের কিতাব সহীহ হাদীসের বিশাল ভান্ডার রয়েছে।