প্রশ্ন : আমার স্ত্রী’র বন্ধ্যাত্ব সমস্যা। এ্যাপোলো ঢাকা-বিশেষজ্ঞ ডা: এর পরামর্শ অনুযায়ী IVF উপায়ে বেবী নিতে চাই। এখানে স্বামীর শুক্রানু নিয়ে স্ত্রীর ডিম্বানুতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় স্থাপন করে আধুনিক ল্যাব টেকনোলজী ব্যবহার করে আল্লাহর ইচ্ছায় ক্লিনিক্যালী বেবী নেওয়া প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে IVF। অন্য বিশেষজ্ঞ ওলামারাও এই ব্যপারে পজেটিব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে এটা নেওয়া যাবে। সারা বিশ্বে এখন এটা বহুল প্রচলিত। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে –এই প্রক্রিয়াটা যদি পুরুষ ডা: করে থাকেন–এইটা কি ইসলামে জায়েয আছে। কারণ এখানে স্ত্রীর পর্দা খেলাপ ও গোপন অঙ্গ প্রদর্শন হচ্ছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে। এখন আমরা কি বাচ্চা নেওয়ার জন্য এই পদ্ধতিটির সুবিধা নিতে পারি?
উত্তর :এ পদ্ধতির শরয়ী হুকুম বর্ণনার পূর্বে সাধারণ পাঠকদের জন্য প্রথমে এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরছি। এরপর বিস্তারিত হুকুম বলা হবে ইংশাআল্লাহ।
আইভিএফ (ivf) এর ফুল মিনিং হচ্ছে IN-VITRO FERTILIZATION (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন)। আইভিএফ বা টেস্ট টিউব পদ্ধতি হচ্ছে মানবদেহের বাইরে গর্ভ ধারণের এক আধুনিক পদ্ধতি। বর্তমানে এই পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতি সন্তান লাভ করছেন। আই.ভি.এফ (IVF) বা টেস্ট টিউব চিকিত্সা পদ্ধতির সফল পদযাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যে লুইস ব্রাউনের জন্মের মধ্য দিয়ে। এই বাচ্চাটির ক্ষেত্রে ফার্টিলাইজেসান করা হয়েছিল একটি টেস্ট টিউবে। এই পদ্ধতিতে প্রকৃতপক্ষে ভ্রুণ টেস্টটিউবে বেড়ে ওঠে না, বাড়ে মায়ের জরায়ুতেই আর দশটি বাচ্চার মতোই। এ পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণু আর নারীর ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণটুকুই শুধু স্বাভাবিক পদ্ধতিতে না হয়ে দেহের বাইরে হয়। স্ত্রীর ডিম্বপাত বা ওভুলেশনের সময় ডিম্বাণু যখন পরিপক্ক হয়, তখন তা ডিম্বাশয় থেকে বের করে আনা হয় ল্যাপারোস্কপি নামের এক পদ্ধতির মাধ্যমে। যে সব নারীর ডিম্ব উৎপাদনে সমস্যা, তাদের ক্ষেত্রে প্রথমে ডিম্ব উৎপাদনে সহায়তা করে এমন কিছু ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ল্যাপারোস্কপি ছাড়াও যোনিপথে ছোট্ট একটি অপারেশনের মাধ্যমেও ডিম্বাণু সংগ্রহ করা যায়। সংগ্রহের পর ডিম্ব রাখা হয় টেস্ট টিউব অথবা বিশেষ ধরণের একটি পাত্রে যার নাম পেট্রিডিশ। এদিকে স্বামীর শুক্রাণু সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরে ডিম্বাণুসহ সেই ডিশ বা টিউবে শুক্রাণু রাখা হয়। এ সময় একটি ডিম্বাণুর বিপরীতে থাকে প্রায় পঁচাত্তর হাজার শুক্রাণু। এরপর ডিশ বা টিউবটি কয়েক ঘন্টা রাখা হয় ইনকিউবিটরে। ইনকিউবেটরের পরিবেশ রাখা হয় জরায়ুর অনুরূপ। এখানে উপযুক্ত শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষেকের ফলে মানব ভ্রুনের সৃষ্টি হয়। তারপর বিশেষ নলের সাহায্যে স্ত্রীর জরায়ুতে রাখা হয় ভ্রণটি। অনেক ক্ষেত্রে, ভ্রণকোষটি জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের আগে বিশেষ প্রক্রিয়ায় হিমায়িত করে রাখা হয় কিছুদিন। বিশেষতঃ যাদের ক্ষেত্রে ডিম্ব উৎপাদন করা হয় ওষুধের সাহায্যে, তাদের জরায়ুর প্রকৃতি ঐ মাসিক চক্রে স্বাভাবিক থাকার সম্ভাবনা কম থাকে। সে কারণে ভ্রণ প্রতিস্থাপনের জন্য পরবর্তী স্বাভাবিক মাসিক চক্রের জন্য অপেক্ষা করা হয়। সব ভ্রুণ অবশ্য কাজে লাগানো হয় না। গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে এদের গুণগত মান পরীক্ষা করে স্কোরিং করা হয়। ভ্রুণে কোষের সংখ্যা যথাযথ বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধির গতির উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ভ্রুণ বাছাই করা হয়।
শরয়ী হুকুমঃ উক্ত পদ্ধতিটি একটি স্বভাবজাত ও প্রাকৃতিক নিয়মের বিপরীত পন্থা। শরীয়াত কখনো এ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে না। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু আপত্তিকর, স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ঢালাওভাবে এ পদ্ধতি সবার জন্য গ্রহন করা জায়েয নয়। কেননা এ পদ্ধতিতে কয়েকটি স্তরে মহিলার সতরের অঙ্গ চিকিৎসকের নিকট প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়। যেখানে মহিলাদের বাহ্যিক আকার আকৃতি ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরপুরুষের নিকট হারাম সেক্ষেত্রে কোন গাইরে মাহরাম পুরুষকে বিশেষ অঙ্গ দেখান কতটা ভয়ঙ্কর তা বলাই বাহুল্য। তাই স্বভাবজাতভাবে বাচ্চা জন্মদানে সক্ষম দম্পতির জন্য এ পদ্ধতি গ্রহন করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। বরং স্বাভাবিকভাবে যারা বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম বা বন্ধ্যা তাদের জন্য এ পদ্ধতি শর্তসাপেক্ষে গ্রহন করা জায়েয। যদিও তাদের জন্য সর্বোত্তম ও নিরাপদ হল এ পদ্ধতি অবলম্বন না করে সবর করা এবং আল্লাহ তাআলার রহমতের অপেক্ষা করা।
সারকথা যে দম্পতি স্বভাবজাত নিয়মে জন্মদানে সক্ষম নয় এবং বাচ্চা নিতে খুব আগ্রহী তারা নিম্নোক্ত শর্তসাপেক্ষে এ পদ্ধতি গ্রহন করতে পারেন। শর্তগুলো হল-
এক. শুক্রাণু ও ডিম্বাণু অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর হতে হবে। কাজেই স্বামীর শুক্রাণু নিয়ে অন্য কোন মহিলার ডিম্বাণুর সাথে অথবা স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে অন্য কোন পুরুষের শুক্রাণুর সাথে নিষিক্তকরণ করা জায়েয নয়।
দুই. শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষিক্তকরণের পর তা স্ত্রীর জরায়ুতেই প্রতিস্থাপন করতে হবে। অন্য কোন মহিলার জরায়ুতেই প্রতিস্থাপন করা যাবে না। এমনকি কোন সতীনের ডিম্বাণু নিয়ে স্বামীর শুক্রাণুর সাথে নিষিক্তকরণের পর অন্য সতীনের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করাও বৈধ নয়। অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর শুক্রাণু ডিম্বাণু নিয়ে নিষিক্তকরণের পর তা ঐ স্ত্রীর জরায়ুতেই প্রতিস্থাপন করতে হবে যার ডিম্বাণু নেওয়া হয়েছিল।
তিন. উক্ত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে যা করা সম্ভব নয় চিকিৎসক কেবল ততটুকুই করবেন।
চার. স্ত্রীর ডিম্বাণু সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপনের সময় অথবা অন্য যে কোন সময় যখন সতর খোলার প্রয়োজন তখন ততটুকুই খুলবে যতটুকু উক্ত পদ্ধতি বাস্তবায়নে একান্ত প্রয়োজন। এবং চিকিৎসকও ততটুকুতেই নজর দিবেন যতটুকু না দেখলে নয়। আর যদি এক্ষেত্রে কোন সহকারী ছাড়াই বা সহকারীর মহিলার সতরের দিকে দৃষ্টি দেওয়া ছাড়াই উক্ত কাজ করা সম্ভব হয় তবে তা-ই করবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে উক্ত কাজগুলো কোন মহিলা চিকিৎসক দিয়ে করাবে।
পাঁচ. উক্ত প্রক্রিয়ার কোন স্তরে স্ত্রীর চিকিৎসকের সাথে একান্তে না হওয়া। এক্ষেত্রে স্বামী তার পাশে থাকবে। তা না হলে অন্তত কোন মাহরাম মহিলা থাকবে। যদিও তার জন্য সতর দেখা জায়েয নয়।
ছয়. চিকিৎসক ও ল্যাব কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও সচেতন হবেন যাতে কোন দম্পতির ভ্রুন অন্য কোন মহিলার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন না করা হয়।
সূত্রসমূহঃ সূরা নূর, আয়াত ৩১; সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৬৮৬; ৫১১৭; সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৪৩২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৩৯৪; তাবইয়ীনুল হাকায়েক ৭/৩৮; মুলতাকাল আবহুর ৪/১৯৯