প্রশ্ন : আমার বোনের এক বান্ধুবী বলেছে হাতে পায়ে মোজা পরতে হবে এটা কুরআনে কোথায় আছে? তার বাবা আগে হানাফী ছিলো এখন আহলে হাদীস। সে তার মেয়েকে হাতে পায়ে মোজা পরতে দেয় না। মুখ ঢেকে রাখার ব্যাপারেও দিমত পোষন করে। ১। এমন একটা দলীল চাইতেছি যেখানে স্পষ্ট প্রমানিত হাতে পায়ে মোজা পরা জরুরী। তাহলে আমার বোন তাকে নিয়ে দেখাতে পারবে।

উত্তর :

পর্দার বিধানটি ইসলামের একটি অকাট্য বিধান। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য জায়গায় এ ব্যাপারে তাকীদ দেওয়া হয়েছে। কোনো মুমিনের জন্য পর্দাকে অবহেলা করার সামান্যতম কোন সুযোগ নেই। আর মহিলাদের সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চেহারা। কাজেই তা খোলা রেখে যে পর্দা সম্ভব নয় এটা যার সামান্যতম বিবেক রয়েছে তিনি খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন। বরং এই ফেতনার জামানায় মহিলাদের জন্য পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক ঢেকে রাখা কর্তব্য। নিম্নে আমরা কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের আসারের আলোকে এ সংক্রান্ত আলোচনা করব ইংশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
অর্থঃ হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব, আয়াত ৫৯)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে।-ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪
ইবনে সীরিন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) আবীদা (সালমানী রাহ.)কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّهِ وَلَا أَنْ تَنْكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أَبَدًا إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمًا
অর্থঃ তোমরা তাঁদের (নবী পত্নীদের) নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। তোমাদের কারো জন্য আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া সংগত নয় এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীদেরকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ঘোরতর অপরাধ। (সূরা আহযাব, আয়াত ৫৩)
এই আয়াত থেকেও বোঝা যায়, নারীর দেহের কোনো অংশই পর্দা-বিধানের বাইরে নয়। উম্মুল মুমিনীনগণের আমলও তা প্রমাণ করে।
এই আয়াতে যখন পর্দার বিধানকে সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মুল মুমিনীনদের জন্যও অধিকতর পবিত্রতার উপায় বলা হয়েছে তখন উম্মতের আর কে আছে যে এই বিধানের বাইরে থাকতে পারে? আর চেহারা খোলা রাখা বৈধ হলে পর্দার আড়াল থেকে চাওয়ার-ই বা কি অর্থ থাকে?
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন-
قل للمؤمنت يغضنن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها
অরথঃ (হে নবী!) মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর, আয়াত ৩১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, ‘সাধারণত যা প্রকাশিত’ অর্থ হচ্ছে কাপড়।-তাফসীরে তাবারী ১৮/১১৯
এই ব্যাখ্যা অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, গায়রে মাহরাম পুরুষের সামনে নারীর মুখমন্ডলসহ পূর্ণ দেহ আবৃত রাখা অপরিহার্য।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وليضربن بخمرهن على جيوبهن
অরথঃ তারা যেন গ্রীবা ও বক্ষদেশ মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। (সূরা নূর , আয়াত ৩১)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) বলেন,
يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها.
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন। আল্লাহ তাআলা যখন
وليضربن بخمرهن على جيوبهن
আয়াত নাযিল করলেন তখন তারা নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করেছিলেন।-সহীহ বুখারী ২/৭০০
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন-‘ফাখতামারনা’ অর্থ তারা মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।-ফাতহুল বারী ৮/৩৪৭
আল্লামা আইনী রাহ. বলেন-‘ফাখতামারনা বিহা’ অর্থাৎ যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী ১৯/৯২)
উক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায়, উপরোক্ত মহিলা সাহাবীগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুখমন্ডল আবৃত করারও আদেশ করেছেন। তাই তারা আল্লাহ তাআলার আদেশ পালনার্থে নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
المرأة عورة وإنها إذا خرجت استشرفها الشيطان وإنها لا تكون أقرب إلى الله منها في قعر بيتها
অর্থঃ নারী হল (আপাদমস্তক) সতর তথা আবৃত থাকার বস্ত্ত। নিশ্চয়ই সে যখন ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তাকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। আর সে যখন গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করে তখন সে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বেশি নিকটে থাকে।-আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস নং ২৮৯০
উপরোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, হাত, মুখ, পাসহ নারীর পুরো শরীরই পর্দার অন্তর্ভুক্ত। বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনাসামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর ওড়না টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম।-মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ২৯৩৫
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা আবশ্যক।
আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) বলেন, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম।-মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪
এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, সাহাবা-যুগের সাধারণ মহিলারাও গায়র মাহরাম পুরুষ থেকে নিজেদের চেহারা আবৃত করতেন। কারণ আসমা বিনতে আবি বকর (রাঃ) এখানে বহুবচন ব্যবহার করেছেন। যা প্রমাণ করে উম্মুল মুমিনগণ ছাড়া অন্য নারীরাও তাদের মুখমন্ডল আবৃত রাখতেন।
ফাতিমা বিনতে মুনযির (রহঃ) বলেন, আমরা আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ)-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম।-মুয়াত্তা ইমাম মালেক ১/৩২৮; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪
অন্য হাদীসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
وَلَا تَنْتَقِبْ الْمَرْأَةُ الْمُحْرِمَةُ وَلَا تَلْبَسْ الْقُفَّازَيْنِ
অর্থঃ ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে। (সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ১৮৩৮)
উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝে আসে মহিলারা নেকাব ও হাতমোজা পরিধান করত। অর্থাৎ হজের সময় ব্যতীত তারা তাদের হাতও ঢেকে রাখত। কেননা তারা যদি এগুলো পরিধান না-ই করত তবে নিষেধ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। তাই হজের সময় এগুলো পরিধান করতে নিষেধ করা হয়।
কাযী আবু বকর ইবনে আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্বের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সাথে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে। (আরিযাতুল আহওয়াযী ৪/৫৬)
অনুরূপভাবে মহিলাদের পা ঢেকে রাখার বিষয়টিও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত কাপড় ঝুলিয়ে রাখে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না। তখন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে মহিলারা তাদের কাপড়ের ঝুল কীভাবে রাখবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক বিঘত ঝুলিয়ে রাখবে। উম্মে সালামা বললেন, এতে তো তাদের পা অনাবৃত থাকবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে এক হাত ঝুলিয়ে রাখবে, এর বেশি নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং : ৪১১৯; জামে তিরমিযী ৪/২২৩; সুনানে নাসাঈ ৮/২০৯
ইমাম তিরমিযী বলেন, এই হাদীসে নারীর জন্য কাপড় ঝুলিয়ে রাখার অবকাশ দেওয়া হয়েছে। কারণ এটিই তাদের জন্য অধিক আবৃতকারী।
এ হাদীস থেকে বুঝে আসে মহিলারা তাদের পা খোলা রাখবে না বরং ঢেকে রাখবে।

Loading