প্রশ্ন : আসসালামু আলাইকুম, যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যু জানার পরেও বোমা-গ্রেনেড বা এজাতীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রু ঘাঁটিতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো এবং ক্ষতিসাধন করা, এটা কি আত্মহত্যা, নাকি সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে?

উত্তর :

ওয়া আলাইকুমুস সালাম

এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়-

এক. বর্তমানে কিছু মানুষকে দেখা যায় তারা শান্তিপ্রিয় মুসলিম সমাজে আত্মঘাতী হামলা চালায়। যার শিকার একমাত্র মুসলমানেরাই হয়ে থাকেন। আল্লাহই ভালো জানেন এদের কি উদ্দেশ্য? এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় মুসলিম হত্যা করা নাকি তাদের ইসলাম কায়েমের একটি পন্থা(?)। জানি না ইসলামপন্থী মুসলমানদেরকে হত্যা করে তারা কিভাবে তারা ইসলাম কায়েম করতে চায়? মুসলিম অধ্যুষিত কোন এলাকায় নির্বিঘ্নে মুসলিম হত্যার সাথে ইসলাম কায়েমের কি সম্পর্ক তা কোনভাবেই বুঝে আসে না। এ কোন পদ্ধতি? বরং এমনটি হলে তো কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহন করবে না। কারন ইসলাম গ্রহন করলেই তাকে ইসলাম কায়েমের স্বার্থে গুপ্তহত্যার দ্বারা জীবন দিতে হবে। তাহলে সে এই ঝুঁকিপূর্ণ ইসলাম কেন গ্রহন করবে? বরং সে দেখবে অমুসলিমদের উপর তো ইসলাম কায়েমের কোন প্রভাবই পড়ে না। কাজেই অমুসলিম থাকাই তো নিরাপদ। অথচ দেখুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন কাফেরদের উপর হামলার ইচ্ছা করতেন নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতেন-

১। হঠাৎ আক্রমন করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “ঈমান গুপ্তহত্যার বিপরীত”। (দেখুন সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ২৭৭১)

২। যাদের উপর হামলা করবেন তাদের নিকট রাতে পৌঁছালে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। রাতে কখনো হামলা করতেন না। (দেখুন সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ২৯৪৩)

৩। যাদের উপর হামলা করবেন তাদের ভিতর থেকে আযানের আওয়াজ শুনলে বা সেখানে মসজিদ দেখলে হামলা করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন “যদি তোমরা মসজিদ দেখো বা আযান শুন তবে কারো সাথে যুদ্ধ করো না”। (দেখুন সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ২৬৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৭৩)

৪। শিশু, বাচ্চা এবং মহিলাদের উপর হামলা করতে এবং তাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করতেন।(দেখুন সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ২৮৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬৪৬)

অথচ আজ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে অসংখ্য মুসলিম শিশু ও মা বোনদেরকে নির্বিঘ্নে হত্যা করা হচ্ছে। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধে কাফেরদের শিশু, মহিলাদেরকেও আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। তাহলে এর সাথে রাসূলের আদর্শের কি ন্যূনতম সম্পর্ক থাকতে পারে?

৫। হামলার পূর্বে দাওয়াত দিতেন। যদি তারা দাওয়াত গ্রহন করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে চলে আসে তবে আর যুদ্ধ করতেন না। (দেখুন সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬১৯)

এবার বলুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলাম কায়েমের সাথে এদের দূরতম কোন সম্পর্ক আছে কি?

খুবই আশ্চর্য হই যখন দেখি এক গোষ্ঠীর লোক ইসলাম কায়েমের (?) স্বার্থে হয় পাকিস্থানে না হয় সিরিয়ায় না হয় ইরাকে না হয় লিবিয়ায় না হয় বাংলাদেশে না হয় অন্য কোন মুসলিম রাষ্ট্রে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে একাধিক মুসলিম ভাইয়ের প্রান ঝরিয়েছে। অথচ এদের নযর কখনো ফিলিস্তিনের গাজা, মিয়ানমার, কাশ্মীরসহ অন্যান্য নির্যাতিত মুসলমানদের উপর পড়ে না। সারা বিশ্বে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালনাকারী, অসহায় মানুষদের উপর হামলাকারীদের উপর তারা কখনো দৃষ্টিপাত করে না।

দুই. শত্রুপক্ষ বলতে কি আমাদের দেশে গুলশানে নিহত ব্যক্তিদের মত শত্রু? এদেরকে হত্যার দ্বারা কি ইসলামের আদৌ কোন লাভ হয়েছে? এ ঘটনা দেখে বা শুনে কেউ কি ইসলাম গ্রহন করেছে বা করবে? এভাবে নিরস্ত্র, নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে কি ইসলাম কায়েম করা যাবে? এর নাম কি জিহাদ? এমন জিহাদ কি কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন?

তিন. যিনি এ কাজ করবেন তার কি নিয়ত এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি কি আত্মহত্যার জন্য এমনটি করছেন নাকি ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এমনটি করছেন? যদি তার আত্মহত্যার দিকটিই মুখ্য হয় তবে তা নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কেননা হাদীস শরীফে আত্মহত্যার শাস্তি হিসেবে যে ধমকি এসেছে তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আত্মহত্যাকারীর স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকার ব্যাপারে তিনটি তাকীদপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। খলিদান, মুখাল্লাদান, আবাদান। এর দ্বারা এই গুনাহের ভয়াবহতা খুবই স্পষ্ট হয়ে যায়। কাজেই ঢালাওভাবে যে এর বৈধতা আসবে না, তা সহজেই অনুমেয়। বরং তার উদ্দেশ্য কেবল শত্রুপক্ষ ঘায়েল করা হবে।

চার. আরেকটি বিষয় হল, এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এটা না করলে কি মুসলমানদের বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে? অথবা মুসলমানদের ব্যাপক স্বার্থে এটা কি না করলেই নয়? অথবা এমনটি না করলে মুসলমানদের পরাজয় নিশ্চিত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে?

উপরোক্ত আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝে আসে।

১। গুপ্তহত্যা হতে পারবে না। কোন অমুসলিম আমাদের দেশে ভিসা নিয়ে আসার অর্থ হল আমরা তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে না। তবে যদি সে এমন কোন কাজ (যেমন কোন মুসলমানকে হত্যা ইত্যাদি) করে যার কারনে তার রক্ত হালাল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন তার বিচারকার্য চালাবে। যে কেউ আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না।

অনুরূপভাবে তাদের দেশে গিয়েও খামাখা কাউকে হত্যা করা যাবে না বা এ কাজ করা যাবে না।

২। যুদ্ধ বাস্তবিক হতে হবে। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে তা আসলেই জিহাদ বা তার অংশ হতে হবে। যেমন বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনে গাজার মুসলমানদের অবস্থান ঈসরাইলের বিপরীতে। হাজারো অসহায় নিরস্ত্র মানুষকে এমনকি শিশু ও মহিলাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় তারা হত্যা করে যাচ্ছে। হায়রে বিশ্বের বিবেক।

আমাদের দেশে গুলশানের হলি আরটিজেনের মত হতে পারবে না। এ তো ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা। এর সাথে জিহাদের কোনই সম্পর্ক নেই।

৩। কর্তার নিয়তের বিষয়টি বিবেচ্য হবে। যতই প্রয়োজনীয়তা এবং ফায়েদাহ থাকুক না কেন আত্মহত্যার নিয়তে হলে তা বৈধতা হারাবে। বরং একমাত্র দ্বীনকে বুলন্দ করাই তার উদ্দেশ্য হতে হবে। 

৪। এর চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে হবে। অর্থাৎ এটা না হলে মুসলমানের বড় আকারের সর্বনাশ হয়ে যাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে বিপর্যয় ঘটবে অথবা অসংখ্য মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে শত্রুর সংখ্যা বেশি হওয়া, পরাজয় নিশ্চিত হওয়া এবং মৃত্যু অবধারিত জানা সত্ত্বেও যেমনিভাবে শত্রুদলের ভিতরে ঢুকে পরা জায়েয তেমনিভাবে এটারও অবকাশ হতে পারে। এরপরেও জিহাদের উল্লেখিত সূরত এবং আত্মঘাতী হামলার মধ্যে বেশ খানিকটা ফারাক রয়েছে। কেননা উল্লেখিত পরিস্থিতিতেও কাফেরদেরকে কচুকাটা করে ফিরে আসার নজীরও কম নয়। কিন্তু আত্মঘাতী হামলাতে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত হাদীসের আওতায় আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি এ কাজ ছাড়াই মুসলমানদের জয় নিশ্চিত হয়ে যায় বা কোন ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশংকা না থাকে তবে তা জায়েয হবে না।

শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বিষয়টি এভাবেই বুঝে আসে। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। একমাত্র তার ইলমই পরিপূর্ণ।

 

Loading