হাদীস ও আসারের আলোকে পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য
বিশেষ হেকমতের কারণেই আল্লাহ তাআলা মানব জাতীকে দুটি শ্রেণীভুক্ত তথা পুরুষ ও মহিলা করে সৃষ্টি করেছেন। আর উভয়ের মাঝে শারীরিক গঠন-আকৃতি, শক্তি-সামর্থ্য, স্বভাব-চরিত্র, নিরাপত্তা, সতর ও পর্দা সহ অনেক বিষয়েই বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। আর এ বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলামী শরীয়াতও বিভিন্ন মাসআলা ও ইবাদাত বন্দেগীর পদ্ধতিতে নারী-পুরুষগত পার্থক্য বহাল রেখেছে। যেমন-
১। মহিলাদের জন্য নাপাকী অবস্থায় রোযা রাখা নিষেধ। তাদের এ রোযাগুলো পরে ক্বাযা করতে হয়। অথচ পুরুষেরা তাদের মত নাপাকই হয় না।
২। খোরপোষের দায়িত্ব পুরুষের উপর বর্তায়। অথচ (পুরুষ থাকা অবস্থায়) মহিলাদের উপর কখনো খোরপোষের দায়িত্ব আসে না।
৩। তালাক প্রদানের অধিকার এককভাবে পুরুষের অথচ মহিলা কখনো স্বামীকে তালাক দিতে পারে না।
৪। পুরুষেরা একসাথে চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পারে। কিন্তু মহিলারা এক সাথে একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না।
৫। পুরুষ হজ ফরজ হলেই একা হজ করতে পারে। কিন্তু মহিলারা মাহরাম পুরুষ ব্যতীত হজে যেতে পারে না।
৬। হজ পালনের সময় পুরুষেরা উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পাঠ করে। অথচ মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে পড়া জরুরী।
অনুরূপভাবে নামাযের বেশ কিছু হুকুম-আহকামেও পুরুষ ও মহিলাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। যেমন-
১। মহিলাদের প্রায় পুরো শরীর নামাযের ক্ষেত্রে সতর। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে সতর হল নাভি থেকে হাটু পর্যন্ত।
২। পুরুষেরা আযান দেয়। অথচ মহিলাদের জন্য আযান দেওয়া জায়েয নয়।
৩। পুরুষ ইমাম ও খতীব হতে পারে। কিন্তু মহিলা ইমাম ও খতীব হতে পারে না।
৪। পুরুষদের জন্য মসজিদে জামাআতে নামায আদায় করা অধিক ছাওয়াবের কারণ হয়। অথচ মহিলাদের জন্য ঘরের একেবারেই অভ্যন্তরে নামায আদায় অধিক ছাওয়াবের কারণ হয়।
৫। জুমা ও ঈদ পুরুষের জন্য জরুরী। মহিলার জন্য নয়।
৬। নামাযে ইমামকে কোন বিষয়ে সতর্ক করার জন্য পুরুষদেরকে তাসবীহের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর মহিলাদেরকে তাসফীক তথা হাতের দ্বারা শব্দ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
উপরের মাসআলা গুলোতে এটা স্পষ্ট যে, নামাযের বেশ কিছু মাসআলায় নারীদেরকে পুরুষদের থেকে ভিন্ন কিছু হুকুম দেওয়া হয়েছে। আর এগুলো তাদের সতর ও পর্দার প্রতি খেয়াল রেখেই দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে মহিলাদের নামায আদায়ের পদ্ধতিতেও তাদের সতর ও পর্দার বিষয়টি বিবেচনা করে পুরুষদের থেকে ভিন্ন কিছু হুকুম দেওয়া হয়েছে। যা হাদীস ও আসার দ্বারা প্রমাণীত।
অথচ এগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই বর্তমানে একদল লোককে দেখা যায় যারা পুরুষ ও মহিলার মাঝে নামাযের পার্থক্যকে অস্বীকার করেন। আমরা পর্যায়ক্রমে হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য ও কর্ম এবং তাবেয়ীগণের আসার উল্লেখ করবো।
হাদীস শরীফ
১। قال الامام ابو داؤد في كتاب المراسيل له و هو جزء من سننه حدثنا سليمان بن داود حدثنا ابن وهب أخبرنا حيوة بن شريح عن سالم بن غيلان عن يزيد بن أبي حبيب أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل (سكت عنه ابو داؤد فهو صالح عنده, و هو مرسل جيد, عضده ما في هذا الباب من موصول و اثار و اجماع و صرح الشمخ ناصر الدين الالباني في سلسلة الاحاديث الضعيفة انه لا علة فيه سوي الارسال)
অর্থঃ তাবেয়ী ইয়াযীদ বিন আবী হাবীব (রহঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর যমীনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়।-কিতাবুল মারাসীল, ইমাম আবু দাউদ, হাদীস নং ৮০; আস সুনানুল কুবরা, ইমাম বায়হাকী, হাদীস নং ৩৩২৫
শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) হাদীসটিকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে, হাদীসটি মুরসাল। অর্থ্যাৎ হাদীসটি মুরসাল হওয়ার কারণে যঈফ হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোন আলোচনাই তিনি দলীল নিয়ে করেননি। অথচ উলূমুল হাদীসের ময়দানে যাদের সামান্যতম বিচরনও রয়েছে তারা খুব ভালোভাবেই জানেন, কোন হাদীস মুরসাল হয়ে যাওয়ার কারণেই অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না। কেননা প্রথমত আয়িম্মায়ে দ্বীনের অধিকাংশের নিকট, বিশেষত স্বর্ণযুগের ইমামগণের নিকট যদি প্রয়োজনীয় শর্তাবলী উপস্থীত থাকে তবে মুরসাল হাদীসও সহীহ হাদীসের মত গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত যে ইমামগণের নিকট মুরসালকে “সহীহ” বলার ব্যপারে দ্বিধা রয়েছে তারাও মূলত কিছু শর্তের সাথে মুরসাল হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করার উপযোগী মনে করেন। আর আমাদের উপরোক্ত হাদীসটিতে উক্ত শর্তাবলী বিদ্যমান রয়েছে। যে কারণেই গায়রে মুকাল্লিদদের বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস (যিনি তৎকালীন আহলে হাদীসদের সবচে বড় আলেম ছিলেন) নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব “আউনুল বারী” (১/৫২০ দারুল রশীদ, হালাব, সিরিয়া) তে লিখেছেন, এই মুরসাল হাদীসটি সকল ইমামের উসূল ও মূলনীতি অনুযায়ী দলীল হিসেবে পেশ করার যোগ্য।
অনুরূপভাবে মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমীর ইয়ামানী “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলূগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সিজদার পার্থক্য করেছেন। অথচ আহলে হাদীস ভাইদের দেখা যায় তারা তাকে নিজেদের লোক মনে করে থাকেন এবং তার এই কিতাবকে নিজের কিতাব মনে করে থাকেন।
২। أَبو مُطِيعٍ الْحَكَمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْبَلْخِىِّ عَنْ عُمَرَ بْنِ ذَرٍّ عَنْ مُجَاهِدٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- :« إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا »
رواه البيهقي في السنن الكبري برقم 3324 في كتاب الصلاة (باب ما يستحب للمراة من ترك التجافي في الركوع و السجود) و اعل بابي مطيع البلخي و لكن الصحيح فيه عندنا قول العقيلي: ” كانا مرجئا صالحا في الحديث الا ان اهل السنة امسكوا عن الرواية عنه ” نقله الحافظ ابن حجر في لسان الميزان 3:247
و قال الشيخ عبد المالك الكملائ: اما ارجاؤه فهو ارجاء السنة كما يدل عليه كتابه الذي رواه عن ابي حنيفة و هو كتاب الفقه الاكبر فاذا ظهر ان امساك من امسك من الرواية عنه كان لاجل الارجاء المزعوم فلا عبرة بهذا الامساك و انما العبرة بما نص عليه العقيلي انه كان صالحا في الحديث فافهم انتهي
অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছন, মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে বলেন, ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে কুবরা, ইমাম বাইহাকী , হাদীস নং ৩৩২৪, অধ্যায়ঃ সালাত, পরিচ্ছেদঃ মহিলার জন্য রুকূ ও সিজদায় এক অঙ্গ অপর অঙ্গ থেকে পৃথক না রাখা মুস্তাহাব)
এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের।
৩। حدثنا محمد بن عبد الله الحضرمي قال حدثتني ميمونة بنت عبد الجبار بن وائل بن حجر عن أبيها عبد الجبار عن علقمة عمها عن وائل بن حجر قال جئت النبي صلى الله عليه و سلم فقال : هذا وائل بن حجر جاءكم لم يجئكم رغبة ولا رهبة جاء حبا لله ولرسوله وبسط له رداءه وأجلسه إلى جنبه وضمه إليه وأصعد به المنبر فخطب الناس فقال لأصحابه : ارفقوا به فأنه حديث عهد بالملك فقلت : ان أهلي قد غلبوني على الذي لي قال : أنا أعطيكه وأعطيك ضعفه فقال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها
رواه الطبراني في الكبير 22/19-20 , قال الهيثمي في مجمع الزوائد (2/272 ) رواه الطبراني في حديث طويل في مناقب وائل من طريق ميمونة بنت حجر عن عمتها أم يحيى بنت عبد الجبار ولم أعرفها ، وبقية رجاله ثقات انتهي.
و قال الشيخ عبد المالك الكملائ: و في الاسناد تعريف كاشف عن هذه المراة, و هي من اتباع التابعين ان لم تكن تابعية, و المستور من هذه الطبقة محتج به علي الصحيح, لا سيما و لحديثها هذا شواهد من الاصول و الاثار
অর্থঃ হযরত ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়ায়েল বিন হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর।-আল মুজামুল কাবীর, তাবারানী ২২/১৯-২০
উল্লেখিত হাদীসটিও হাসান পর্যায়ের।
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে এ কথা একেবারে স্পষ্ট যে, মহিলাদের নামায আদায়ের পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন। কারণ তাদের ক্ষেত্রে নামাযে সতর ও পর্দার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা নামাযের রোকনগুলো এমনভাবে আদায় করবে যেন তা সতরের জন্য অধিকতর উপযোগী হয়। যা দ্বিতীয় হাদীস থেকে একেবারেই স্পষ্ট। কিন্তু সমুদ্রতুল্য বিশাল হাদীস ভান্ডারের কোথাও এমনটি নেই যে পুরুষ ও মহিলার নামাযে কোন পার্থক্য নেই।
সাহাবায়ে কেরামের আসার
১। খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী (রাঃ) এর বক্তব্য-
عن إسرائيل عن أبي إسحاق عن الحارث عن علي قال إذا سجدت المرأة فلتحتفز ولتلصق فخذيها ببطنها
অর্থঃ হযরত আলী (রাঃ) বলেন, মহিলা যখন সিজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।-মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৯৩; সুনানে কুবরা, ইমাম বাইহাকী, বর্ণনা নং ৩৩২২
এই রেওয়ায়েতটির সনদ উত্তম। হারেছ ব্যতীত সকলেই বুখারী মুসলিমের রাবী। আর হারেছের ব্যপারে সঠিক মন্তব্য হল তিনি ছেকাহ ( নির্ভরযোগ্য)।
২। হিবরুল উম্মাহ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ফাতওয়া-
حَدَّثَنَا أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْمُقْرِئ ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي أَيُّوبَ ، عَنْ يَزِيدَ بْنِ أَبِي حَبِيبٍ ، عَنْ بُكَيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ الأَشَجِّ ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ ؟ فَقَالَ : تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِز
অর্থঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, মহিলারা কিভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন, খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৯৪
এই বর্ণনাটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর এই বর্ণনা থেকে এটা একেবারেই স্পষ্ট যে, মহিলাদের জড়সড় হয়ে নামায পড়ার বিধানটি শুধুমাত্র সিজদার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পূরো নামাযেই তারা জড়সড় হয়ে থাকা ও এক অঙ্গের সাথে অন্য অঙ্গ মিলিয়ে রাখার প্রতি যত্নবান হবে।
উপরে যে দুজন সাহাবার বক্তব্য আনা হয়েছে তারা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বিজ্ঞ আলেম ও ফকীহ ছিলেন। আর এটাই স্বাভাবিক যে তারা এ বক্তব্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেই তবে দিয়েছেন। আর হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে কোন একজন সাহাবী থেকে এর বিপরীত কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না।
তাবেয়ীগনের ফাতওয়া
১। হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহঃ) এর ফাতওয়া যিনি মক্কাবাসীদের ইমাম ছিলেন-
حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ ، قَالَ : أَخْبَرَنَا شَيْخٌ لَنَا ، قَالَ : سَمِعْتُ عَطَاءً ؛ سُئِلَ عَنِ الْمَرْأَةِ كَيْفَ تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلاَةِ ؟ قَالَ : حَذْوَ ثَدْيَيْهَا
অর্থঃ হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, নামাযে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে? তিনি বললেন, বুক বরাবর।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৪৮৬
অন্য বর্ণনায় রয়েছে-
عن بن جريج عن عطاء قال تجتمع المراة إذا ركعت ترفع يديها إلى بطنها وتجتمع ما استطاعت فإذا سجدت فلتضم يديها إليها وتضم بطنها وصدرها إلى فخذيها وتجتمع ما استطاعت
অর্থঃ হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ (রহঃ) বলেন, মহিলারা যখন রুকূ করবে তখন জড়সড় হয়ে করবে। হাত উঁচু করে পেটের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অতঃপর যখন সিজদাহ করবে দুই হাত শরীরের সাথে মিলিয়ে রাখবে। পেট ও সিনা রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে।–মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯
এই বর্ণনাটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ।
২। হযরত ইবরাহীম নাখায়ী (রহঃ) এর ফাতওয়া যিনি কুফাবাসীদের ইমাম ছিলেন-
حَدَّثَنَا أَبُو الأَحْوَصِ ، عَنْ مُغِيرَةَ ، عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : إذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَضُمَّ فَخِذَيْهَا ، وَلْتَضَعْ بَطْنَهَا عَلَيْهِمَا
অর্থঃ হযরত ইবরাহীম নাখায়ী (রহঃ) বলেন, মহিলা যখন সিজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৯৫
অন্য বর্ণনায় রয়েছে-
عن معمر والثوري عن منصور عن إبراهيم قال كانت تؤمر المرأة أن تضع ذراعها وبطنها على فخذيها إذا سجدت ولا تتجافى كما يتجافى الرجل لكي لا ترفع عجيزتها
অর্থঃ হযরত ইবরাহীম নাখায়ী (রহঃ) বলেন, মহিলাদের আদেশ করা হত তারা যেন সিজদা অবস্থায় হাত ও পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। পুরুষের মত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা না রাখে যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে।-মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭১
উপরোক্ত বর্ণনা দুটির সনদ সম্পূর্ণ সহীহ।
হযরত ইব্রাহীম নাখায়ী (রহঃ) এর উপরোক্ত বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট ভাবেই বুঝে আসে যে, তখন মহিলাদের ভিন্ন পদ্ধতিতে নামায শিক্ষা দেওয়ার প্রচলন সাধারণ ও ব্যপক ছিল। আর كانت শব্দ দ্বারাও এটা বোঝা যায় যে, এ তালীম পূর্ব থেকেই চলে আসছিল। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের যুগেই এই তালীমের ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং মহিলারা সাধারণত পুরুষদের থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে নামায আদায় করতেন।
৩। মুজাহিদ ইবনে জাবর (রহঃ) এর ফাতওয়া যিনি মক্কাবাসীদের ইমাম ছিলেন-
حَدَّثَنَا جَرِيرٌ ، عَنْ لَيْثٍ ، عَنْ مُجَاهِدٍ ؛ أَنَّهُ كَانَ يَكْرَهُ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ بَطْنَهُ عَلَى فَخِذَيْهِ إذَا سَجَدَ كَمَا تَصْنَعُ الْمَرْأَةُ
অর্থঃ হযরত মুজাহিদ বিন জাবর (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি পুরুষের জন্য মহিলার মত উরুর সাথে পেট লাগিয়ে সিজদা করাকে অপছন্দ করতেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ২৮৯৬
এই বর্ণনাটির সনদ সহীহ।
৪। ইবনে শিহাব যুহরী (রহঃ) এর ফাতাওয়া যিনি মদীনাবাসীদের ইমাম ছিলেন-
حَدَّثَنَا رَوَّادُ بْنُ جَرَّاحِ ، عَنِ الأَوْزَاعِيِّ ، عَنِ الزُّهْرِيِّ ، قَالَ : تَرْفَعُ يَدَيْهَا حَذْوَ مَنْكِبَيْهَا.
অর্থঃ হযরত যুহরী (রহঃ) বলেন, মহিলা কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাবে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৪৮৭
৫। হাসান বসরী ও কাতাদাহ ইবনে দিআমা (রহঃ) এর ফাতওয়া যারা উভয়ে বসরাবাসীদের ইমাম ছিলেন-
عن معمر عن الحسن وقتادة قالا إذا سجدت المرأة فإنها تنضم ما استطاعت ولا تتجافى لكي لا ترفع عجيزتها
অর্থঃ হযরত হাসান বসরী ও কাতাদা (রহঃ) বলেন, মহিলা যখন সিজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সিজদা দিবে না যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে।-মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৮
এই বর্ণনাটির সনদ সহীহ।
৬। খালেদ ইবনে লাজলাজ (রহঃ) এর ফাতওয়া যিনি সিরিয়াবাসীদের ইমাম ছিলেন-
حَدَّثَنَا إسْمَاعِيلُ ابْنُ عُلَيَّةَ ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ ، عَنْ زُرْعَةَ بْنْ إِبْرَاهِيمَ ، عَن خَالِدِ بْنِ اللَّجْلاَجِ ، قَالَ : كُنَّ النِّسَاءُ يُؤْمَرْنَ أَنْ يَتَرَبَّعْنَ إذَا جَلَسْنَ فِي الصَّلاَةِ ، وَلاَ يَجْلِسْنَ جُلُوسَ الرِّجَالِ عَلَى أَوْرَاكِهِنَّ ، يُتَّقي ذَلِكَ عَلَى الْمَرْأَةِ ، مَخَافَةَ أَنْ يَكُونَ مِنْهَا الشَّيءُ
অর্থঃ হযরত খালেদ বিন লাজলাজ (রহঃ) বলেন, মহিলাদেরকে আদেশ করা হত যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। আবরণযোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় মহিলাদেরকে এমনটি করতে হয়।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৯৯
এছাড়াও আয়িম্মায়ে তাবেঈনের আরো বেশ কিছু বর্ণনা রয়েছে যা থেকে এ কথা দিবালকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মহিলাদের নামাযের পদ্ধতি পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন। আয়িম্মায়ে তাবেঈনের কোন একজন থেকে এর বিপরীত কোন বক্তব্য প্রমাণীত নেই।
অনুরূপভাবে ফুকাহায়ে কেরামও এ বিষয়ে একমত যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। আয়িম্মায়ে মাযহাবের চার ইমামেরই অভিন্ন বক্তব্য হল, মহিলাদের নামাযের পদ্ধতি পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন।
সারকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মারফূ রেওয়ায়েত থেকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণীত হয় যে, পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পদ্ধতি এক নয়। বরং তাদের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে সতর ঢাকা এবং পর্দার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২৩ বছরের তালীমী হায়াতে সাহাবায়ে কেরাম তার থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বা তিনি তাদেরকে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তাও অনুরূপ।
অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নামাযে পার্থক্যের কথা বলতেন। এর বিপরীতে তাদের থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না। আবার তাদের থেকে যে সকল তাবেঈন দ্বীন শিক্ষা করেছিলেন তাদের মাঝেও পুরুষ ও মহিলাদের নামাযের পার্থক্যের বিষয়টি স্বীকৃত ছিল। যেমনটি আমরা উপরের আসারগুলো থেকে বুঝতে পেরেছি। মোট কথা সোনালী তিন যুগের সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক নয় বরং পার্থক্য রয়েছে।
গাইরে মুকাল্লিদ আলেমদের ফাতওয়া
যুগ যুগ ধরে চলে আসা উম্মতে মুসলিমার এই সর্ব সম্মত ও দলীল ভিত্তিক আমলের স্বীকৃতি লা মাযহাবী বা গাইরে মুকাল্লিদ ভাইদের নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরামও দিয়েছেন এবং তারা সে অনুযায়ী ফাতওয়াও দিয়েছেন।
মাওলানা মুহাম্মদ দাউদ গযনবী (রহঃ) এর পিতা আল্লামা আব্দুল জাব্বার গযনবী (রহঃ) কে যখন জিজ্ঞেস করা হল, মহিলাদের নামাযে জড়সড় হয়ে থাকা কি উচিত? জবাবে তিনি একটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন-
“এর উপরই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের চার মাযহাব ও অন্যান্যের মাঝে আমল চলে আসছে।“
এরপর তিনি চার মাযহাবের কিতাবের উদ্ধৃতি প্রদান করার পর লিখেন, মোটকথা মহিলাদের জড়সড় হয়ে নামায পড়ার বিষয়টি হাদীস ও চার মাযহাবের ইমামগণ ও অন্যান্যের সর্বসম্মত আমলের আলোকে প্রমাণিত। এর অস্বিকারকারী হাদীসের কিতাবসমূহ ও উম্মতে মুসলিমার সর্বসম্মত আমল সম্পর্কে বেখবর ও অজ্ঞ।-ফাতওয়ায়ে গযনবীয়্যা ২৭ ও ২৮; ফাতওয়ায়ে ওলামায়ে আহলে হাদীস ৩/১৪৮-১৪৯; মাজমুআয়ে রাসায়েল, মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর উকারবী ১/৩১০-৩১১
মাওলানা আলী মুহাম্মদ সাঈদ সাহেব “ফাতাওয়া ওলামায়ে আহলে হাদীস” এ এই পার্থক্যের কথা স্বীকার করেছেন।-মাজমুয়ায়ে রাসায়েল ১/৩০৫
আর মাওলানা আব্দুল হক হাশেমী মুহাজিরে মক্কী সাহেব তো এই পার্থক্য সম্পর্কে স্বতন্ত্র পুস্তিকাই রচনা করেছেন। পুস্তিকাটির নাম نصب العمود في تحقيق مسئلة ” تجافي المراة في الركوع و السجود و القعود”
আর ইতিপূর্বে নবাব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবের “আউনুল বারী”র এবং মুহাদ্দিস আমীর ইয়ামানীর “সুবুলুস সালামের” উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রথমজন তো তৎকালীন আহলে হাদীসদের সবচে বড় আলেম ছিলেন।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, আলবানী সাহেব নবুয়্যতের যামানা থেকে আজ অবধি চলে দলীলভিত্তিক এ আমলের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে তার “সিফাতুস সালাত” নামক কিতাবে হুট করেই ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক।
এই দাবীর স্বপক্ষে না তিনি কোন আয়াত পেশ করেছেন না কোন হাদীস, না কোন সাহাবী বা তাবেয়ীর আসার বা ফাতওয়া। আর তার উক্ত দাবির মূল ভিত্তি হল, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্যের ব্যপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। আর আমাদের উল্লেখিত হাদীস তিনটির শুধুমাত্র প্রথমটিকে উল্লেখ করে মুরসালা বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। অথচ তার উচিত ছিল আমাদের উল্লেখিত হাদীস গুলোর দালীলিক পর্যালোচনা করা।
এরপর তার দাবির সমর্থনে তিনি যে আশ্চর্যজনক কাজটি করেছেন তা হল ইব্রাহীম নাখায়ী নাকি বলেছেন تفعل المراة في الصلاة كما يفعل الرجل। উদ্ধৃতি দিয়েছেন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার। অথচ উক্ত বক্তব্যটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার কোথাও নেই। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন ভুল উদ্ধৃতি তিনি কিভাবে লিখে দিলেন তা তিনিই ভালো জানেন। অথচ আমরা ইতিপূর্বে সহীহ সনদে উদ্ধৃতি সহ ইব্রাহীম নাখায়ীর বক্তব্য পেশ করেছি যেখানে স্পষ্টভাবে পুরুষ ও মহিলার নামাযে পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে।
আলবানী সাহেব তার দাবির স্বপক্ষে আরেকটি দলীল পেশ করেছেন। আর তা হল ইমাম বুখারী (রহঃ) এর রিজালশাস্ত্রেরে একটি কিতাব “তারীখে সগীর” থেকে নিম্নোক্ত বর্ণনাটি পেশ করেছেন-
عن ام الدرداء انها كانت تجلس فى الصلاة جلسة الرجل
অর্থঃ উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নামাযে পুরুষের মত বসতেন।
অথচ উক্ত রেওয়ায়েত থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। যদি উভয় বসার পদ্ধতি এক হত, তাহলে “পুরুষের মত বসা” কথাটির কোন অর্থ থাকে না। তাই উক্ত বক্তব্য এটাই প্রমান করে যে, সেই যামানায় পুরুষদের মত মহিলারা বসতো না। সব মহিলা পুরুষদের থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে বসত। কিন্তু তিনি পুরুষদের ন্যায় বসতেন। আর তার এই ভিন্নভাবে বসার কারনেই এটি ইতিহাসের বর্ণনায় চলে এসেছে।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হল, হযরত উম্মে দারদা (রহঃ) হলেন একজন তাবেয়ী। আলবানী সাহেব তার দাবি প্রমাণে একাধিক মারফূ রেওয়ায়েতকে উপেক্ষা করার পাশাপাশি বিশিষ্ট ফকীহ সাহাবাদের বক্তব্যর প্রতি কর্ণপাত না করে একজন মহিলা তাবেয়ীর আমলকে পেশ করেছেন। কিন্তু যখন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি মুরসাল রেওয়ায়েত পেশ করলাম তখন তা তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। হায় আশ্চর্য! আমাদের মুরসাল রেওয়ায়েত দলীল হিসেবে পেশ করার যোগ্য হচ্ছে না অথচ তার মাকতু রেওয়ায়েত অনেক বড় দলীল বনে যাচ্ছে।
কাজেই যদি নামাযের পদ্ধতি প্রমাণের ক্ষেত্রে তাবেয়ীদের আমল দলীল হয়ে থাকে এবং বাস্তবও তাই, তাহলে ইতিপূর্বে বিখ্যাত একাধিক তাবেয়ী ইমামগণের উদ্ধৃতিতে মহিলাদের নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আয়িম্মায়ে তাবেয়ীদের তালীম ও শিক্ষা অনুযায়ী রুকু সিজদা ও বৈঠকসহ একাধিক আমলের মধ্যে মহিলাদের নামায পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন ছিল। এক্ষেত্রে তাদের বিপরীতে শুধুমাত্র একজন তাবেয়ী মহিলার ব্যক্তিগত আমলকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করাটা কিছুতেই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশেষ করে যখন ঠিক এই বর্ণনাটির মাঝেই সুষ্পষ্ট একথার ইংগিত রয়েছে যে, এক্ষেত্রে এ মহিলা অন্য সাহাবী ও তাবেয়ী মহিলা থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
অবশেষে আমাদের লা মাযহাবী ভাইদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ যদি কাউকে মানতেই হয় বা অনুসরণ করতেই হয় তবে নুবুয়্যতের বার-তেরশত বছর পরের কাউকে না মেনে সোনালী তিন যুগের কাউকে মানার মধ্যেই অধিকতর কল্যান রয়েছে। বিশেষভাবে যার লেখনী অসংখ্য অগণিত পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে সমৃদ্ধ। আর যার উদ্ধৃতির বাস্তবতা সম্পর্কে একটু পূর্বেই অবগত হলাম। তার অনুসরণ যে কতটা ভয়াবহ তা জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই অনুমান করতে পারবেন। পক্ষান্তরে সোনালী যুগের লোকদের মাঝে ভরপুর কল্যান ও কামিয়াবীর বিষয়টি হাদীস শরীফ থেকে স্পষ্ট। তাই অনুসরণ করলে কেবল তাদেরই অনুসরণ করা উচিত।
একটি ভ্রান্তি নিরসন
অনেকেই একটি হাদীস থেকে ভুল বুঝে থাকেন। আর তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ, সেভাবেই নামায পড়ো।–সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৬৩১, ৬০০৮, ৭২৪৬
কাজেই হাদীসে তো নারী-পুরুষ সকলকে আদেশ করা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত নামায পড়তে। তাহলে নারীদের জন্যে নামায আদায়ের ভিন্ন পদ্ধতি এল কোত্থেকে?
আসলে হাদীসটি নারী-পুরুষ সকলের জন্যেই প্রজোয্য; তবে সেটা পদ্ধতিগত বিষয়ে নয়, বরং হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে। যেমন, কিয়াম রুকু সিজদা কওমা জলসা সালাম এ সবগুলো হুকুম আদায় করতে হবে একাগ্রতার সাথে, শান্ত ও ধীরতার সাথে। কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো করা যাবে না। অর্থাৎ যেখানে যখন যা প্রযোজ্য সেখানে তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণেই আমল করতে হবে।
বিখ্যাত হাদীসবিশারদ হযরত মোল্লা আলী কারী (রহঃ) বলেন, এই হাদীসটির দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তোমরা যেভাবে আমাকে নামায আদায় করতে দেখেছ সেভাবে নামায আদায় করবে। অর্থাৎ হুকুমটি প্রযোজ্য হবে নামাযের শর্ত ও রুকুন অর্থাৎ যাবতীয় ফরজ আমলগুলো যথাযথ আদায়ের ক্ষেত্রে। হাদীসে আল্লাহর রাসূল এ কথা বলেননি, পুরুষ-নারীর নামায আদায়ের পদ্ধতি এক। তবে তারা ফরজ আমলগুলোর যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমান। এ ব্যাখ্যাটিই অধিকতর সঠিক। নারী-পুরুষের নামায আদায়ের পদ্ধতি অবশ্যই ভিন্ন। বিষয়টি প্রমাণিত অসংখ্য হাদীস ও আসারের মাধ্যমে।-মিরকাতুল মাফাতীহ ৩৫১/২
আবার কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে উক্ত হাদীসে নামাযের মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ কিয়াম থেকে সালাম পর্যন্ত সব বিধানের ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সকলে সমান। সবাইকেই এ বিধানগুলো সমানভাবে আদায় করতে হবে। তবে এ বিধানগুলো কে কিভাবে আদায় করবে, তা এই হাদীসে বলা হয়নি। বরং আকৃতিগত ভিন্নতার কারণে তাদের জন্যে অন্য হাদীসে স্পষ্টভাবেই ভিন্ন পদ্ধতির নির্দেশনা রয়েছে।
বুখারী শরীফের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, হাদীসটি দিয়ে নারী-পুরুষের নামায আদায়ের পদ্ধতির অভিন্নতার বিধান দেয়া যায় না।
পরিশেষে ফুকাহায়ে কেরাম উপরোক্ত হাদীস ও আসারগুলো থেকে যে সকল ক্ষেত্রে মহিলাদের নামাযে পদ্ধতিগত ভিন্নতার কথা বলেছেন তা নিম্নে দেওয়া হল-
দাঁড়ানো অবস্থায়
১। তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় হাত কাপড়ের ভিতর হতে বের না করা। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ১৬৮৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৬, ৫০৬৭)
২। তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় উভয় হাত বুক বরাবর এমনভাবে উঠানো যাতে হাতের আঙ্গুলগুলো কাধ বরাবর হয়ে যায়। (ত্বাবারানী কাবীর ২২/২৭২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৪৭১,২৪৭৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৬)
৪। হাত বুকের উপর বাঁধা। (আস-সিআয়া ২/১৫৬)
৫। দাঁড়ানো অবস্থায় হাত যথাসম্ভব শরীরের দিকে চেপে রাখা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৭)
রুকু অবস্থায়
১। রুকুতে পুরুষদের তুলনায় কম ঝুঁকা (এতটুকু পরিমান ঝুঁকবে যাতে হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌছে যায়)। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৫৯)
৩। রুকুতে উভয় বাহু পাজরের সঙ্গে সম্পূর্ন মিলিয়ে রাখা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯)
৪। রুকুতে উভয় হাতের আঙ্গুল সমূহ পরিপূর্ন মিলিয়ে হাঁটুর উপর স্বাভাবিকভাবে রাখা। পুরুষদের ন্যায় আঙ্গুল ফাঁক করে হাটু না ধরা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯)
সিজদা অবস্থায়
১। কনুইসহ উভয় হাত মাটিতে মিলিয়ে রাখা। পুরুষদের ন্যায় কনুই উঁচু করে না রাখা। (মারাসীলে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৮৪; সুনানে বাইহাক্বী, হাদীস নং ৩৩২৫)
২। উভয় রানের সাথে পেট মিলিয়ে রাখা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯, ৫০৭২; সুনানে বাইহাক্বী, হাদীস নং ৩৩২৪)
৩। উভয় হাতের বাহু যথাসম্ভব পাজরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৭৮)
৪। একেবারে জড়সড় ও সংকুচিত হয়ে সিজদা করা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৮১,২৭৮২; সুনানে বাইহাক্বী , বর্ণনা নং ৩৩২৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭১)
৫। সিজদায় ডান দিক দিয়ে উভয় পা বের করে মাটিতে বিছিয়ে রাখা এবং উভয় পায়ের আঙ্গুল সমূহ যথাসম্ভব কিবলামুখী করে রাখা। (সুনানে বাইহাক্বী, হাদীস নং ৩০১৬, ৩৩২৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৭৭,২৭৮৩ ; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৮)
৬। এক রানের সাথে আরেক রান যথাসম্ভব মিলিয়ে রাখা। (সুনানে বাইহাক্বী, হাদীস নং ৩০১৬, ৩৩২৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭১)
৭। নিতম্ব যথাসম্ভব জমীনের সাথা মিলিয়ে রাখা,উঁচু না করা। (মারাসীলে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৮৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৮২)
বসা অবস্থায়
১। বাম নিতম্বের উপর বসা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৮৩,২৭৯২; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭৪)
২। ডান দিক দিয়ে উভয় পা বের করে দিয়ে কিবলামুখী করে মাটিতে বিছিয়ে রাখা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৮৩,২৭৯২; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৭৪, ৫০৭৭; কিতাবুল আসার, ইমাম মুহাম্মাদ, আসার নং ২১৬)
৩। উভয় রান যাথাসম্ভব মিলিয়ে রাখা। (সুনানে বাইহাক্বী, হাদীস নং ৩৩২৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বর্ণনা নং ৫০৬৯, ৫০৭৭)
৪। বাম পা, ডান রান ও গোছার নিচের রাখা। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৮৩; আওজাযুল মাসালিক ২/১১৮)
৫। বৈঠকে উভয় হাতের আঙ্গুল সমূহ মিলিয়ে হাঁটু বরাবর করে রাখা। ( মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ২৭৭৮)