মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সামাজিকতা মেনেই মানুষকে চলতে হয়। এই সামাজিকতার অন্যতম ও গুরত্বপূর্ন একটা দিক হল বিবাহ। যদিও এর মধ্য ইবাদতের দিকটাই অগ্রগন্য। আসলে মুমিনের জীবনে দুনিয়া বলতে কিছু নেই। তার জীবনের পুরোটাই আখেরাতের নিমিত্ত্বে। যেমনটি আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থাৎ মুমিন যখন তার সকল কাজ (চাই ব্যাক্তিগত ও মানবিক প্রয়োজন হোক বা খালেছ ইবাদত হোক) রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত তরিকায় করবে তখন তা ইবাদতে পরিনত হবে। কাজেই মুমিনের ২৪ ঘন্টা ইবাদাত সম্ভব।
ইসলামী শরীআতে এই বিবাহের গুরূত্ত অপরিসীম। এমনকি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিবাহ করল না তার সম্পর্কে হাদিসে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত বা দলভুক্ত না হওয়ার ধমকী এসেছে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল্লূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন বিবাহ আমার সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যে আমার সুন্নাতের উপর আমল করল না সে আমার দলভুক্ত নয়। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৮৪৬।
এই বিবাহের বিপরীতে রয়েছে তালাক। অর্থাৎ বিবাহ যেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের একটি মাধ্যম তেমনিভাবে তালাক সম্পর্ক বিচ্ছেদের একটি মাধ্যম। এই তালাকের রয়েছে জরুরী কিছু বিধি-বিধান। যা প্রত্যেক বিবাহিত ও বিবাহিচ্ছুক নর-নারীর জানা জরুরী। তা না হলে দুনিয়াতে যেমন চরম ভোগান্তি ও দুর্বিষহ যন্ত্রনায় পড়তে হয় তেমনিভাবে আখেরাতেও ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। অথচ এ সংক্রান্ত মাসাইল সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ।
আমাদের সাধারন ওয়াজ মাহফিলগুলো যেমন এ সংক্রান্ত আলোচনা থেকে মুক্ত তেমনিভাবে মসজিদের মিম্বারগুলোও এ বিষয়ে নির্বাক। যার কারনে সামাজিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছে গিয়েছে। তাই এই বিষয়ে জরুরী কিছু মাসাইল আলোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন মনে করছি। কেননা মানুষ অনেক সময় এমন কথা বলে বা কাজ করে যার দ্বারা তার অজান্তে তার স্ত্রী চিরতরে হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সংসার চালিয়ে গেলে সে যেনাকারী সাব্যস্ত হবে এবং সন্তান হারামজাদা গন্য হবে। সাধারন মুসলমান ভাইদেরকে তা থেকে বাঁচানোর জন্যই এই প্রয়াস। নিম্নে কিছু জরুরী মাসআলা উল্লেখ করা হল।
উল্লেখ্য যে, এখানে মাসআলাগুলো লেখার দ্বারা উদ্দেশ্য হল যাতে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো থেকে বাঁচতে পারি। এগুলো পড়ে ফাতওয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে মাসআলাগুলো লেখা হয়নি। এমনকি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো কারো ঘটে গেলে সেক্ষেত্রেও সে এর উপর আমল করবে না। বরং অবশ্যই কোন নির্ভরযোগ্য দারুল ইফতা বা মুফতী সাহেবের স্মরনাপন্ন হবে।
মোটকথা মাসআলাগুলো লেখার দ্বারা উদ্দেশ্য হল অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। এবং রাগের মাথায় যে কোন ধরনের শব্দ মুখে উচ্চারণ না করা। কেননা অনেককে দেখা গেছে একটি কথার দ্বারাই তার জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছে এবং সারাজীবন তার জের বহন করছে। তাই ঝগড়াঝাঁটির সময় শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
মাসআলাঃ কেউ তার স্ত্রীকে ঠাট্টা করে তালাক দিলে তা পতিত হয়ে যাবে।-তিরমিজী শরীফ হাদীস নং-১১৮৪।
মাসআলাঃ কেউ তালাকের মিথ্যা স্বীকারোক্তি করলে তা পতিত হয়ে যায়। অর্থাৎ পূর্বে তালাক না দিয়েও কেউ যদি তালাক দিয়েছে বলে থাকে তা পতিত হয়ে যাবে। -রদ্দুল মুহতার ৩/২৩৮।
মাসআলাঃ রাগান্বিত অবস্থায় তালাক দিলে তালাক পতিত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে মদ্যপ অবস্থায় মাতাল হয়ে তালাক দিলে তা পতিত হয়। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৩৫৩, আল মুহীতুল বুরহানী ৩/৩৪৮, আদ্দুররুল মুখতার /২৩৫,২৪১,২৪৪।
মাসআলাঃ কেউ তার স্ত্রীকে বলল “আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি” এর দ্বারা তালাক হয়ে যাবে। চাই তার তালাকের নিয়ত থাক বা না থাক। -রদ্দুল মুহতার ৩/২৯৯, আলমগিরী ১/৩৭৯।
মাসআলাঃ তালাক পতিত হওয়ার জন্য সাক্ষীর সামনে তালাক দেওয়া বা স্ত্রীর উপস্থিতিতে তালাক দেওয়া জরুরী নয়। বরং কেউ একাকী নির্জনে তার স্ত্রীকে তালাক দিলে তা কার্যকর হয়ে যাবে। -ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম ৯/৪৮,৪১,৬৮।
মাসআলাঃ মৌখিকভাবে তালাক দিলে যেমনিভাবে তালাক পতিত হয় তেমনিভাবে মুখে উচ্চারণ ব্যাতীত লিখিতভাবে তালাক দিলে তা পতিত হয়। -রদ্দুল মুহতার ৩/২৪৬, ২৪৭।
মাসআলাঃ কেউ তালাকনামায় সজ্ঞানে স্বাক্ষর করলে লিখিত তালাকনামা অনুযায়ী তালাক পতিত হয়। -তাতারখানিয়া ৩/৩৮০।
মাসআলাঃ কেউ উকীলকে বা অন্য কাউকে বলল “আমি স্ত্রীকে তালাক দিব” তালাকনামা লিখুন। এর দ্বারাই তার স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হবে। চাই সে তালাকনামা লিখুক অথবা না লিখুক। -তাতারখানিয়া ৩/৩৭৯, রদ্দুল মুহতার ৩/২৪৬।
মাসআলাঃ স্পষ্টভাবে তালাক দিলে (যেমন কেউ তার স্ত্রীকে বলল আমি তোমাকে তালাক দিলাম) নিয়তের প্রয়োজন নেই। তার নিয়ত যা-ই থাকুক না কেন তালাক পতিত হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২, রদ্দুল মুহতার ৩/২৪৭।
মাসআলাঃ কেউ একই মজলিসে এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হবে। এক তালাক নয়। চাই সে এক শব্দে তিন তালাক দিক বা ভিন্ন শব্দে। উভয় অবস্থায় তিন তালাক পতিত হবে। আর এটাই চার ইমামের মাযহাব। -সুরা বাকারাহ আয়াতঃ ২৩০, সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫২৬১,৫২৫৯, সুনানে নাসাই, হাদীস নং৩৪১, সুনানে বাইহাকী, হাদীস নং ১৪৭৩৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং ১১৩৪৩।
মাসআলাঃ স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে শরঈ হালালা ব্যতীত তার সাথে ঘর-সংসার করা নাজায়েয ও হারাম। যদি অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় অতঃপর দ্বিতীয় স্বামী তাকে স্বেচ্ছায় তালাক দেয় তবে ইদ্দত পালনের পর ১ম স্বামীর সাথে পূনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। -সূরা বাকারাহ, আয়াত নং ২৩০, সহীহ বুখারী, হাদীস নং৫২৬১,৫২৫৯।
মাসআলাঃ কেউ রাগান্বিত অবস্থায় স্ত্রীকে বলল তুমি ইদ্দত পালন কর বা তুমি এখন থেকে একা বা তুমি স্বাধীন বা তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম তবে এর দ্বারা একটি বায়েন তালাক পতিত হবে যদিও তার তালাকের নিয়ত না থাকে। -আদ্দুরুল মুখতার ৩/২৯৬-২৯৮, আলবাহরুর বায়েক ৩/৫১৮-৫২৩, ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম ৯/৩১০।
মাসআলাঃ স্ত্রী বা অন্য কেউ স্বামীর নিকট তালাক চাইল।স্বামী স্ত্রীকে জবাবে বলল তুমি মুক্ত বা তুমি আমার জন্য হারাম বা তুমি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন বা তুমি ইদ্দত পালন কর বা তুমি এখন থেকে একা বা তুমি স্বাধীন তবে কোন নিয়ত ব্যতীত স্ত্রীর উপর একটি বায়েন তালাক পতিত হবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৩/২৯৬-২৯৮,তাবয়ীনুল হাকায়েক ৩/৭৮।
মাসআলাঃকেউ তার স্ত্রীকে বলল “তুমি আমার জন্য হারাম”এর দ্বারা তার স্ত্রীর উপর একটি বায়েন তালাক পতিত হবে ।-রদ্দুল মুহতার ৩/৪৩৩, ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম ৯/৩০২।
মাসআলাঃ তালাক বায়েন হলে নতুন করে মোহর ধার্য্য করে দুজন সাক্ষীর সামনে ঈজাব কবুলের দ্বারা বিবাহ দোহরানো ব্যতীত স্ত্রী হালাল হবে না। -ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৪৭২।
উল্লেখিত বিষয়গুলোর কোন একটির দ্বারা তালাক হলে কোন ক্ষেত্রে ফিরিয়ে নেওয়ার দ্বারা, কোন ক্ষেত্রে বিবাহ দোহরানো দ্বারা, কোন ক্ষেত্রে বিবাহ দোহরানো দ্বারা কোন ক্ষেত্রে শরঈ হালালার দ্বারা স্ত্রী ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। তবে স্ত্রী হারাম হওয়ার অন্য একটি সুরত রয়েছে যাকে “হুরমতে মুছাহারাহ” বলে। এর দ্বারা স্ত্রী চিরতরে কেয়ামত পর্যন্ত হারাম হয়ে যায়। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু মাসআলা আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরী মনে করছি।
মাসআলাঃ যদি কোন পুরুষ ও মহিলা একে অপরকে কামভাবে (শাহওয়াতের সাথে) স্পর্শ করে অথবা পুরুষ মহিলার লজ্জাস্থানের ভিতরে কামভাব নিয়ে দৃষ্টি দেয় তবে তাদের প্রত্যেকের জন্য অপরের উপরের সিঁড়ি ও নিচের সিঁড়ির সকলে চিরতরে হারাম হয়ে যায়। অর্থাৎ তাদের কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না। আর কেউ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকলে সে চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। একে হুরমতে মুছাহারাহ বলে। -এলাউস সুনান-১১/১৩১,১৩২, রদ্দুল মুহতার-৩/৩১-৩৩।
মাসআলাঃ কেউ তার শাশুড়ী বা মেয়েকে কামভাব নিয়ে স্পর্শ করলে তার স্ত্রী তার জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যায়। -রদ্দুল মুহতার ৩/৩১-৩৩।
মাসআলাঃ কোন মহিলা তার ছেলে বা শ্বশুরকে কামভাবে নিয়ে স্পর্শ করলে তার স্বামী তার জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যায়। ¬-আদ্দুররুল মুখতার ৩/৩১-৩৩।
মাসআলাঃ হুরমতে মুছাহারাহ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য কামভাব উভয়ের হওয়া শর্ত নয় বরং যে স্পর্শ করেছে বা যাকে স্পর্শ করা হচ্ছে কোন একজনের কামভাব এলেই হুরমতে মুছাহারাহ সাব্যস্ত হবে।-¬রদ্দুল মুহতার ৩/৩৬।
মাসআলাঃ হুরমতে মুছাহারাহ সাব্যস্ত হতে হলে সরাসরি শরীরে স্পর্শ হতে হবে অথবা এমন কাপড়ের উপরে স্পর্শ হতে হবে যার উপরে শরীরের উষ্ণতা অনুভুত হয়।-আদ্দুররুল মুখতার ৩/৩১।
কাজেই পুরুষের জন্য শাশুড়ি ও মেয়ের ( সাবালেগ হলে বা সাবালেগের নিকটবর্তী হলে) সাথে চলাফেরার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। অনুরূপভাবে মহিলার জন্য শ্বশুর ও ছেলের ( সাবালক বা সাবালকের নিকটবর্তী হলে) সাথে চলাফেরার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন একান্ত প্রয়োজন। নতুবা সামান্য ভুলের কারনে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক চিরতরে হারাম হয়ে যেতে পারে।
এখানে আরেকটি জরুরী বিষয় হল, স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার শরঈ পদ্ধতি ও নীতিমালা রয়েছে। তালাক দেওয়ার পূর্বে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তা সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরী। তাই কেউ তালাক দিতে চাইলে ( যা শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে নিকৃষ্ট কাজ) অবশ্যই তালাক দেওয়ার পূর্বে কোন বিজ্ঞ মুফতী সাহেবের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তদানুযায়ী আমল করবে। অথচ অত্যন্ত আফসোসের ও পরিতাপের বিষয় আমাদের অধিকাংশ ভাই রাগের মাথায় একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং এক সাথে এক বৈঠকেই স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেন। অতঃপর কোন দারুল ইফতা বা মুফতি সাহেবের নিকট গিয়ে কান্নাকাটি করেন এবং ধন্না দেন। অথচ তখন গিয়ে তো কোন লাভ নেই। কেননা ডাক্তারের কাছে লাশ নিয়ে গেলে কোন লাভ হয় না। তাছাড়া এক সাথে তিন তালাক দেওয়া মারাত্মক ও জঘন্যতম গুনাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সুখী দাম্পত্য জীবন দান করুন। আমীন।